গাদলা

গাদলা

হোক না তা বানানো, তবু তো নদীর শব্দ; খুব খুশ!

১৯৩৮ এর সেই বিকাল – তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে দশবারোজনের একটা দল উৎকণ্ঠিত চিত্তে স্টেশানের প্লাটফর্মে সমিতির ভাবমূর্তি নিয়ে যৎপরনাস্তি উদ্বিগ্র। সভাপতি স্বয়ং উপস্থিত, যদিও তাঁর নিমটাকটাকে প্রবল অস্থিত স্বেদ চকচকে করে তুলেছে; তিনি হুঁশিয়ার লোক সন্দেহ নাই, সন্দেহ পুরাদলটার বেহুঁশামিতে। সবাই সাহিত্য অন্তপ্রাণ; কিন্ত আজকের ছোট্ট এই রেলথামার সেডটার নিচে যে ঘামাঘামি অবস্থা – কোর্ট ফেরৎ পেশাদারী সাক্ষীরা অথবা আঠারবাড়ী বা নান্দাইল যাবার মানুষগুলি তা দেখে তো নাইই, স্টেশানে সর্বদা বিরাজমান প্লাটফর্ম সেডটি নিজেই শেষ কবে দেখেছে তা মনে করতে সময় লাগছে; হয়তো বা দেখা যাবে, যাকে নিয়ে এই ঘাম-বের-করা অবস্থা – সে-ই ছিল বার বছর আগে শেষ সেই ব্যক্তি।

সভাপতি নিজের চাকুরি মহিমায় নয়, সত্যিকার কারণেই আজ (তারমতো) ঠান্ডা মানুষটা বারবার ঘেমে উঠছে। পথে কোন ক্লেশ হচ্ছে না তো? সাথে যার আসার কথা সে সময়মতো ফুলবাড়ীয়া উপস্থিত ছিলো তো? যে লম্বা ভ্রমণ, সদ্য যুবকেরাই নাকাল হয়ে পড়ে আর তার না জানি কী হয়!

স্টেশানের ঘনব্যস্ততা কিছুক্ষণের মধ্যে গা সওয়া ও খানিকটা তথাগতের শরণে যেন বা সহনীয় শব্দ পর্যায়ে নেমে আসে।

জ্ঞানতাপস যখন চিরপরিচিত স্নিগ্ধ অবয়বটি নিয়ে ট্রেন থেকে নামলেন, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ললিত বাবু দেখলেন, বিন্দুমাত্র ক্লান্তির ছাপ নাই তার। দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ভৈরব লাইনের ট্রেনে এমন অক্লেশে কেমন করে ভ্রমণ করলেন জ্ঞানতাপস?

সম্ভাষণ জানিয়ে কাছে গিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবেন সভাপতি ললিত মোহন, জ্ঞানতাপস আগেই তার জবাব দিলেন, যেন বলার আগেই মানুষের মনের কথা তার প্রতিভাসিত মানসমুকুরে ছায়া ফেলে যায়।

: ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, এ পথ আমার পূর্ব পরিচিত। আর জানেনইতো, চেনা পথ সব সময়ই ছোট। ১৯২৫ সনে আমি একবার কিশোরগঞ্জ এসেছিলাম, ঠিক কিশোরগঞ্জ নয়, পাকুন্দিয়া, একটা সাহিত্য সমিতির ডাকে। এক যুগেরও আগের কথা, অথচ মনে হচ্ছে এই সেদিন।

: আপনারা স্যার যুগোত্তর মানুষ, সময় আপনাদের পায়ের তলা দিয়ে গড়িয়ে যায়; আমাদের মতো পাপীতাপীদের সময় হাতির পা – ভারী, সহজে নড়েচড়ে না।

জ্ঞানতাপস বুঝলেন না লোকটা নিজেকে জাহির করতে চাইছে, নাকি বিনয়বশত: এমন করেই কথা বলেন। মনে মনে একটু হাসলেন – ভালইত মিলিয়েছে। স্টেশন সেডের বাইরেটা অনবরত বৃষ্টিতে লাঞ্ছিত ও ক্লান্ত। ললিত বাবু বললেন : গত সাতদিন ধরে এই রকম, প্রতি বছরই হয়, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আরকি, এর নাম গাদলা | জ্ঞানতাপস শব্দটা শুনে আশেপাশে অপরিচিতের ভীড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন ।

প্লাটফর্মের এখানে সেখানে ছোটছোট কয়েকটি দল অপেক্ষা করছিল। সভাপতির সাথেও কয়েকজন। এরাই সবচেয়ে বয়স্ক ও গণ্যমান্য। অপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা আরেকটু দূরে, তরুণেরাও আছে। তবে বয়স যাই হোক, সবাই আর দশটা সাধারণ জনের চাইতে আলাদা; সবারই ভারিক্কি ভাব; অনেকের চোখেই চশমা, পোশাকে শাদার আধিক্য, কয়েকজনের মাথায় তুর্কী ফেজ টুপি। তবে জ্যেষ্ঠ দলটা নিজেদের ঠেসে ঠুসে আটকে রেখেছে যা সচরাচর কনিষ্ঠদের মধ্যে দেখা। জোর করে ওদের ফুটো দিয়ে প্রাণচাঞ্চল্য বেরিয়ে পড়ছে। তরুণদের কয়েকজনের হাতে দিনপঞ্জী। জ্ঞানতাপস অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন, করমর্দনেও এগিয়ে যাচ্ছিলেন স্মিতহাস্যে কিন্ত্র কদমবুচিকে প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন না যদিও কয়েকজন উঁবু হয়ে এগিয়ে আসছিল। এদেরকে এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া দু:সাধ্য। নানা পেশার অনেকেই এসেছে। পরিচয়ে বোঝা গেল কেউ কেউ পদাধিকার বলে। ‘২৫ সনে পরিচয় হয়েছিল এমন কেউ কেউ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল পদাধিকারে ভারীদের নি:শব্দ হুংকারে। জ্ঞানতাপস তাদের কাউকে কাউকে চিনতে পেরে নিজেই এগিয়ে গেলেন।

শহরের মান্যগণ্য অনেকেই এসেছেন। কেউ সাহিত্যের টানে, কেউ তার জ্ঞান গরিমার বিস্ময়কর দ্যুতি মুগ্ধতায়, কেউ কেউ সাজাত্যাভিমানে। জ্ঞানতাপস অবশ্য আলোকপ্রাপ্তদের ভীড় ছাড়িয়ে তাকাচ্ছিলেন আশেপাশে ম্যালেরিয়া বা কালাজ্বরাক্রান্ত কেউ আছেন কিনা তা দেখতে। কারণ অনেকে তাঁকে ধ্বন্বন্তরি বলে জানে, নামের প্রারন্তে ড. ধ্বনি সংযুক্তির কারণে (আগের বার এই ঝামেলা ছিল না, ফ্রান্স থেকে ফেরার পর এই পালকের যন্ত্রণা)। আর সবাইকে এড়ানো চলে, কিন্ত স্ফীতপ্লীহা বা কালা অ্যা-জ্বর গ্রস্থ (এ অঞ্চলে সাংবৎসর যার প্রাদুর্ভাব) কারো নজর থেকে নিজেকে রক্ষা করার বিদ্যা এখনো তাঁর অনায়াত্ত্ব।

একযুগ আগে পাকুন্দিয়ার আলহক সাহিত্য সামিতি-র পল্লী সাহিত্য সম্মেলনে এসেছিলেন এমনি করেই ট্রেনে চড়ে; ট্রেনে আসতে আসতে ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন সেদিনকার মূল প্রবন্ধের খুঁটিনাটি। প্রবন্ধের নামটি ছিলো খুবই সাদামাটা; ইচ্ছা করেই এরকমটা করেছিলেন। যাদের জন্য এই অভিভাষণ, তারা যাতে উসখুস না করে। নাম ছিল : পল্লী সাহিত্য ।

হঠাৎ মনে পড়ল সেই কিশোর মুখটির কথা! জ্ঞানতাপস নিজের মনে একটু হাসলেন তার কথা মনে পড়াতে। সেই চোখেমুখে ছোটনদী নরসুন্দারব্রীঢ়া। শ্যামল কিশোর কবি।

ওর কাছেই শোনেন প্রবীর গোস্বামীদের কথা। কথাটা ওঠে পল্লী সাহিত্য ও ম্যালেরিয়ার প্রসঙ্গে। মুখচোরা কিশোর একবার ম্যালেরিয়ায় ভোগার পর থেকে তার মুখে আর টগবগ করে কথা ফুটছিল না। কুইনাইনিনের কুপ্রভাব? জিভ যেন পল্লী সাহিত্যের আঞ্চলিক উচ্চারণ ছাড়া আগাতেই পারে না। কেমন জড়িয়ে আসে। ভদ্রসমাজের উপযোগী ভাষা ওখানে অসম্ভব।

: আমি ঘরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম। আমি চাইলেও আর পারছিলাম না: তবে আপনার কথা শোনার পর আমি চাইও না। আমার জীবনে একটা জরুরি ঘটনা হল আলহকের ঐ দিনটা। জানতাম নরসুন্দা আর জেগে উঠবে না। এটা কিশোরগঞ্জের সবাই জানে। তবু কেউ মেনে নেয়নি। এই জনপদের সবার তীব্র আকাঙ্খা-দৃশ্য, কোনো এক বর্ষায় এক ভীষণ গাদলার পর জেগে উঠবে নরসুন্দা ৷ কুইনাইন আমাকে ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু ঠেলে দিয়েছে পল্লী সাহিত্যের জীবনে। এখন আমি প্রবীর গোস্বামীর মতো মুমুরদিয়ার ঘটনা ঘটাতে পারব।

কটিয়াদির বনগ্রামে জন্ম নেয়া এই বিপ্লবী সরকারী ডাক লুট করেছিলেন।আচমিতার কেদার নাথ রায়ের টাকা ছিল এদিনের ডাকে।

জ্ঞানতাপস চমকে ওঠেন গোস্বামী-র প্রসঙ্গে। বলেন : ওদের লক্ষ্য ছিল রাজশক্তি, সেজন্য ক্ষাত্রশক্তির প্রয়োগ দরকার হত, তোমার কেন গোস্বামী-শক্তি চাই?

: আমাকে কি ভদ্রলোকেরা সহজে মেনে নেবে?

: তুমি যা করতে চাইছ ওটা নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে

১৯২০ থেকে ৩০ সময়টাই কি কিশোরগঞ্জের অগ্নিযুগ? এখানে তখন সৃষ্টি হচ্ছে বিচিত্র সব ঘটনা। একদিকে নিষ্ঠুর প্রজানিপীড়ক জমিদার শ্রেণী অন্যদিকে তাদের অতিষ্ঠ খাতকবৃন্দ, যারা অবশেষে হয়ে ওঠে জনগণ এবং গঠন করে গণআদালত যার রায় শেষ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ না করায় অবশেষে পুড়িয়ে মারার শাস্তি বলবৎ হয় (পাকুন্দিয়ার জাংগালিয়া গ্রামের মহাজন বাবু কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ১৯৩০ শালের জুলাই মাসে বন্ধকীদলিল ফেরৎ দেবার দাবীতে পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর ও কটিয়াদির খাতকরা বিদ্রোহ করে ও শেষ পর্যন্ত কি্ষ্টবাবু কৃষকদের উপর গুলি চালালে তার খড়ের গাদা ভেঙ্গে পলায়নের জন্য আনা গাড়ির পেট্রোল ঢেলে বাড়ির সকল ঘরে আগুন দেয়। বাড়ির প্রায় সকলেই জনতার হাতে নিহত হন।)

জ্ঞানতাপস খুঁজছিলেন সেই কিশোর কবিকে। সে কি আজ এসেছে? আঞ্চলিক ভাষাকে আশ্রয় করে যে লতিয়ে উঠতে চেয়েছিল? তার জিভ আজ কিভাবে উচ্চারণ করছে? সেখানে কি “গাদলা” আনন্দরূপ পেয়েছে?

ট্রেন থেকে নামার পর সব কিছুতে খুব বিচলিত বোধ হচ্ছে। শব্দগুলির ভবিষ্যৎ কী? তা কি শুধু মানুষের সাথে ব্যাপারি মহাজনদের যোগাযোগের কাজেই লাগবে?

 

 

প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ১৯৯৮
গল্পটি ‘গতকাল লাল’ গল্প সংকলন (প্রকাশক: জনান্তিক, ফেব্রুয়ারি ২০০৭) থেকে লেখকের অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশিত হলো। © দ্বৈত বনতুলশী )
page top Image by Monika from Pixabay

Loading

সংক্ষিপ্ত বায়োগ্রাফি কাজল শাহনেওয়াজ। কবি ও কথাশিল্পী। জন্ম বিক্রমপুরের লৌহজং থানার দিঘলী গ্রামে (এখন পদ্মাগর্ভে বিলীন), ১৯৬১ সালের পয়লা জুন। পিতা আবু বকর সিদ্দিক পেশায় ভেটেরেনারী ডাক্তার ছিলেন। মায়ের নাম সুরাইয়া। বর্তমানে কিশোরগঞ্জে স্থায়ী নিবাস। শৈশব কাটে ফরিদপুরে। তারপর কৈশোর ও যৌবন কিশোরগন্জ। বর্তমানে ঢাকায়। ময়মনসিংহস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি প্রকৌশলে গ্রাজুয়েশন। পেশা শুরু করেন সেচ প্রকৌশলী হিসাবে, দুই বছর পরে তথ্য প্রযুক্তি। পেশাগত দক্ষতা অর্জন করেন জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সিস্টেম বিষয়ে। বার বছর চাকুরি করার পর আরও বার বছর স্বনিয়োজিত হিসাবে কাজ করেছেন একটা সফটঅয়্যার প্রতিষ্ঠান চালিয়ে। এক সময় পছন্দ ছিল নতুন নতুন প্রোগ্রামিং ভাষা শেখা ও তাতে কাজ করা। জীবনের উচ্চ ও নীচ, সফল ও অসফল, সামান্য ও অসামান্য – সব কিছুতেই অপরিসীম আকর্ষণ নিয়ে বসবাস করেন ঢাকায়। কবিতায় কল্পনা ও গদ্যে বাস্তবতা দিয়ে শুরু করেছিলেন লেখালেখি। বর্তমানে বাংলার ভূমি-ইতিহাস-রাজনীতি প্রধান আগ্রহ। কাজ করেছেন গ্রাম ও নগর দুই ধরণের জগতেই। প্রকাশিত বই: কবিতা ছাঁট কাগজের মলাট (১৯৮৪), জলমগ্ন পাঠশালা (১৯৮৯), রহস্য খোলার রেঞ্চ (১৯৯২), আমার শ্বাসমূল (২০০৭), কাঠকয়লায় আঁকা তোমাকে আমার (২০০৯), তালগাছ হাতির বাচ্চা (২০১১), একটা পুরুষ পেপে গাছের প্রস্তাব (২০১৫), একটা ব্যাঙনি আমাকে পিঠে চড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে (২০১৯),কবিতাসমগ্র (২০১৮) ছোটগল্প কাছিমগালা (১৯৯৩), গতকাল লাল (২০০৭), কাছিমগালা ও গতকাল লাল (২০১১), গল্পসমগ্র (২০১৮) সাক্ষাৎকার ঘোড়ার প্রেমপত্র (২০২০) উপন্যাস শে (২০২১) সম্পাদনা বিকল্প কবিতা, যৌথ সম্পাদনা, ১৯৮৯ ফৃ, লিটল ম্যাগাজিন, ১৯৯৫-৯৮ ফৃ গ্রন্থিকা সিরিজ (পাতলা মলাটের এক ফর্মার বই), ১৯৯৮-৯৯, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫

9 Comments

  1. “শব্দগুলির ভবিষ্যৎ কী? তা কি শুধু মানুষের সাথে ব্যাপারি মহাজনদের যোগাযোগের কাজেই লাগবে?” শেষের এই লাইনটি পড়তেই চমকে উঠলাম। এত এত শব্দ অপচয় করি রোজ কিন্তু কখনো ভেবে দেখিনি এই শব্দগুলোই কি ভাবে আগলে রেখেছে আমাদের! শুভেচ্ছা নেবেন সুন্দর গদ্যের জন্য!

  2. চমৎকার

  3. অভিনন্দন। ভালো লাগায়
    গাদলাময় কাহিনী।

  4. গাদলা মানে কি? অভিনন্দন।

    • ‘গাদলা’ মানে হচ্ছে বর্ষা কালীন দীর্ঘ বৃষ্টি। কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ব্যবহৃত শব্দ।

  5. welcome

  6. অভিনন্দন

  7. পড়া শেষে বলতে পারি “ যৎপরনাস্তি” শব্দটা মোর, যৎপরনাস্তি জানা।

  8. অসাধারণ লেখা

Leave a Reply

Skip to toolbar