
চারটি পুরানো গল্প : একটি নতুন বিবেচনা
এই প্রবন্ধে চারটি গল্প আলোচনার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। প্রথম গল্পটি প্রচলিত কৌতুক হিসাবে, দ্বিতীয় গল্পটি মূলত শিক্ষামূলক, রচয়িতা ঈশপ হতে পারেন। তৃতীয় গল্পটি নেয়া হয়েছে আবুল ফজল অনুদিত উইল ডুরান্টের “দর্শনের ইতিকাহিনী” গ্রন্থ থেকে এ কাহিনীটি সেখানে ভলতেয়ার প্রসঙ্গে আলোচনার সময় উদ্ধৃত হয়েছে। চতুর্থ গল্পটি হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের একটি রূপকথা। আলোচনায় দেখানো হবে যে, গল্পগুলোতে ব্যবহৃত যুক্তি-কাঠামো তাদের বক্তব্যের সঙ্গে কিভাবে দ্বন্দ্ব এবং প্রতি-বক্তব্যের সুযোগ তৈরি করছে। চতুর্থ গল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, গল্পে বর্ণিত ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যা কিভাবে নূতন বিশ্লেষণের এক সম্ভাবনাকে উন্মোচন করছে।
প্রথম গল্প : মাঝি ও পণ্ডিত
প্রথম গল্প এক মাঝি ও এক উন্নাসিক পণ্ডিতের। এ গল্পটি লোকমুখে কৌতুক হিসাবে প্রচলিত। গল্পটি চমকপ্রদ ও আপাত দৃষ্টিতে অব্যর্থ। গল্পটি এ রকম :
এক পণ্ডিত নদী পার হবার জন্যে নৌকায় উঠেছিলো নৌকায় মাঝি ও পণ্ডিত ছাড়া আর কেউ নেই। উঠেই পণ্ডিত মাঝিকে জিজ্ঞেস করলো, বেদ পড়েছো? মাঝি বলল পড়েনি। পণ্ডিত বলল, তাহলে তোমার জীবনের চার আনাই বৃথা। মাঝি চুপ। নৌকা চলছে। আরো কিছুক্ষণ পরে পণ্ডিত আবার প্রশ্ন করলো, উপনিষদ পড়েছো। মাঝি এবারও বলল: না। পণ্ডিত বলল, তাহলে তোমার জীবনের আট আনাই বৃথা। আরো কিছুক্ষণ পরে নৌকা মাঝ নদীতে। অকস্মাৎ আকাশ কালো করে ঝড় উঠলো। এবার মাঝি জিজ্ঞেস করলো, পণ্ডিতজি, আপনি সাঁতার জানেন? পণ্ডিত ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, না। মাঝি বলল : তাহলে পণ্ডিতজি, আপনার জীবনের ষোল আনাই বৃথা। মাঝি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতে লাগলো। আর পানিতে ডুবে পণ্ডিতের সলিল সমাধি ঘটলো।
এই গল্পটির উদ্দেশ্য পণ্ডিত-মনষ্ক লোকদের প্রতি বিদ্রূপ প্রকাশ এবং এটা বলা যে, বিদ্যার অহংকার করা ঠিক নয়। বলা হচ্ছে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যায় জীবন সীমাবদ্ধ নয়, বইয়ের বাইরে যে জগত আছে সেখানে এ ধরনের বিদ্যা অচল। গল্পের ব্যাখ্যাকে সম্প্রসারিত করে পণ্ডিতকে দার্শনিক ও শিল্পী-সমাজের প্রতিনিধি এবং মাঝিকে বৈষয়িক কর্মে ব্যস্ত মানুষের প্রতিনিধি মনে করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বলা যায় যে, তাদের পরস্পর বিরোধিতা ও সংঘাত-প্রবণতা এ গল্পের একটি উৎস। গল্পে পণ্ডিত পরাজিত পক্ষ এবং এভাবে দার্শনিক ও শিল্পী-সমাজকে এক হাত দেখে নেয়া হয়েছে। কিন্তু গল্পে যে যুক্তি-কাঠামো ব্যবহার করা হয়েছে তা মেনে নিয়ে আমরা যদি গল্পের ঘটনাটিকে অসংখ্যবার ঘটতে দেই তাহলে পণ্ডিতই শেষমেশ (উন্নাসিক হওয়া সত্ত্বেও) বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হবে। গল্প অনুসারে – বেদ ও উপনিষদ না পড়লে জীবনের চার যোগ চার মোট আট আনা (শতকরা পঞ্চাশ ভাগ) বৃথা। সাঁতার না জানলে ষোল আনা (শতকরা একশ ভাগ) বৃথা। সাঁতার না জানলে ষোল আনা তখনই বৃথা হবে যখন ঝড় উঠবে এবং পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটবে। সে হিসাবে এ গল্পে মাঝিই বিজয়ী পক্ষ। কিন্তু, ঝড় ওঠার ঘটনাটি একটি আকস্মিক ঘটনা, স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ঝড় না উঠার সম্ভাবনা সবসময় ঝড় উঠার সম্ভাবনার চেয়ে বেশি। এজন্য এ গল্পের ঘটনাটিকে যদি অসংখ্যবার ঘটতে দেয়া যায়, তাহলে পণ্ডিতের জীবন কখনো ষোলআনা, কখনো শুণ্য-আনা কিন্তু গড়ে আটআনা অপেক্ষা কম ব্যর্থ হবে। অপরদিকে মাঝি বেদ ও উপনিষদ না পড়ায় তার জীবন সবসময় আটআনা ব্যর্থ থাকবে, ঝড় উঠা বা না উঠার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না। এছাড়া মনে রাখা প্রয়োজন ঝড় উঠলেও নৌকা নাও ডুবতে পারে এবং সাঁতার না জানা সত্ত্বেও কেউ না ডুবে বেঁচে যেতে পারে। অন্যদিকে সাঁতার জানা সত্ত্বেও ঝড়ে উত্তাল নদীতে ডুবে মৃত্যু অসম্ভব নয়।
গল্পে বর্ণিত ঝড় জীবনের চলার পথে বিপদ ও প্রতিকূলতার প্রতীক। সে বিপদ ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার আগ পর্যন্ত কি কোন সুনিশ্চিত পূর্বজ্ঞান সম্ভব? সেজন্য যাবতীয় পূর্বপ্রস্তুতির ভিত্তি থাকে অনুমান ও পূর্ব অভিজ্ঞতায়, যা একপ্রকার পুঁথিগত বিদ্যাই।
দ্বিতীয় গল্প : কাঠুরে ও তার ছেলে
এবারের গল্প এক কাঠুরে, তার বুড়ো অসুস্থ বাবা ও ছেলেকে নিয়ে। গল্পটি নানাভাবে প্রচলিত থাকতে পারে। গল্পটি এরকম :
এক বনের ধারে বাস করত এক কাঠুরে। তার সংসারে আছে তার বউ, বুড়ো অসুস্থ বাবা ও একমাত্র ছেলে। বুড়োর সঙ্গে নাতির খুব খাতির। কিন্তু কাঠুরের বউ বুড়োকে একদম দেখতে পারে না। কাঠুরে খুব গরীব। সারাদিন বনে কাঠ কেটে বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যায় তাতে সংসার চলে না। বউ সারাদিন ঝগড়া করে, সংসারে দুঃখকষ্ট নিয়ে নানা কথা বলে। বউয়ের গঞ্জনায় অতিষ্ঠ হয়ে কাঠুরে ঠিক করল বাবাকে বনে ফেলে দিয়ে আসবে। পরদিন ভোরে, কাঠুরে বুড়োকে একটা ঝুড়িতে করে বনের দিকে রওনা হলো। কাঠুরের ছেলে আগেই সব টের পেয়েছিলো। সে চেঁচিয়ে বলল, “বাবা, ঝুড়িটা ফেরত আনতে ভুলে যেওনা, তুমি যখন বুড়ো হবে তোমাকেও তো ঝুড়িতে করে ফেলে দিয়ে আসতে হবে।” ছেলের কথায় কাঠুরের হুশ ফিরল। সে লজ্জিত হয়ে বাবাকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসল।
গল্পটি বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি সদয় হতে বলছে। বলা হচ্ছে, একদিন তুমিও বুড়ো হবে, তখন তোমার সন্তানরাও তোমার প্রতি অ-সদয় হতে পারে। কিন্তু গল্পের বর্ণনা মতে, (অন্ততপক্ষে এ ধরনের ব্যাখ্যার সুযোগ দিয়ে থাকে) কাঠুরে তার বৃদ্ধ বয়সে ছেলে কর্তৃক যে দুর্দশা ভোগ করবে তা হবে তার কৃতকর্মের ফল। সে হিসাবে বুড়ো বাবা এখন যে দুর্দশা ভোগ করছে তা হতে পারে তার যৌবনকালের কৃতকর্মের ফল।
তৃতীয় গল্প : ব্রাহ্মণ ও বৃদ্ধা
এবারের গল্প এক ব্রাহ্মণ ও বৃদ্ধাকে নিয়ে। গল্পটি নেয়া হয়েছে আবুল ফজল অনূদিত উইল ডুরান্টের “দর্শনের ইতিকাহিনী” গ্রন্থ থেকে। গল্পটি উদ্ধৃত হয়েছে ভলতেয়ার প্রসঙ্গে আলোচনার সময়। ভলতেয়ার কাহিনীটির আদি রচয়িতা হতে পারেন আবার প্রাচীন কোন কাহিনীকেও ব্যবহার করতে পারেন। কাহিনীটি নিচে উদ্ধৃত হলো :
তিনি এক সৎ ব্রাহ্মণের গল্প বলেছেন। এ ব্রাহ্মণ সবসময় বলতো, “আমার জন্ম না হলেই ভালো হতো।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন এরকম বলছেন? ব্রাহ্মণ উত্তরে বললেন, এ চল্লিশ বছর ধরে আমি শুধু অধ্যয়নই করেছি, এখন দেখতে পাচ্ছি এ দীর্ঘকাল আমার অনর্থক নষ্ট হয়েছে। আমার বিশ্বাস আমি পদার্থে তৈয়ারি, কিন্তু চিন্তার কি করে উৎপত্তি হয় তা আমি আমার মনকে পারিনি বুঝাতে। আমার বোধ শক্তিটা ঠিক হাঁটা অথবা হজম করার মতো এক সহজ প্রক্রিয়া কিনা সে সম্বন্ধে আমি আজো অজ্ঞ, অথবা হাত দিয়ে আমি যেমন একটা জিনিস ধরি চিন্তাটাও কি আমার মাথার সাহায্যে সেভাবেই করে থাকি? আমি বকবক করে অনেক কথাই বলি, কিন্তু কথা শেষ হওয়ার পর আমি প্রায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি, আর এতক্ষণ ধরে যা বলেছি তার জন্য বোধ করতে থাকি লজ্জা।
সেদিনই তার প্রতিবেশী এক বৃদ্ধার সঙ্গে আমার আলাপ। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার আত্মাটা কিভাবে তৈরি হয়েছে তা না জেনে তুমি কি খুব অস্বস্তি বোধ কর? আমার প্রশ্নটি যেন সে বুঝতেই পারলো না। যেসব বিষয় নিয়ে সৎ ব্রাহ্মণটি এতকাল ধরে নিজেকে কষ্ট দিয়ে এসেছে – সারাজীবনে এক মুহূর্তের জন্য বুড়ি সে সম্বন্ধে এতটুকু ভাবেনি। সে তার অন্তরের অন্তঃস্থলে থেকে বিষ্ণুর রূপান্তর, তথা অবতার-রূপ গ্রহণে বিশ্বাস করে। যদি গঙ্গার পবিত্র জলে একবার স্নানের সুযোগ পায় তা হলে নিজেকে মনে করবে সবচেয়ে সুখী মেয়েমানুষ। এ দরিদ্র মেয়েটির মুখের কথায় মুগ্ধ হয়ে আমি আমার দার্শনিকটির কাছে ফিরে এসে বললাম : “এরকম শোচনীয় জীবন যাপন করতে তোমার কি লজ্জা হয় না, যখন তোমার থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে একটা বৃদ্ধা কোন বিষয়েই কিছুমাত্র ভাবনা-চিন্তা না করে সন্তুষ্ট চিত্তে জীবন কাটাচ্ছে? তিনি উত্তরে বললেন, “তোমার কথা সত্য। আমি আমার মনকে অন্তত হাজার বার বলেছি আমার বৃদ্ধা প্রতিবেশিনীর মতো আমিও যদি অজ্ঞ হয়ে থাকি তা হলে আমিও সুখী হতে পারি; কিন্তু এরকম সুখে আমার মন সুখী হতে চায় না।”
ব্রাহ্মণের এই উত্তর কতটুকু গ্রহণযোগ্য। আপাতত আকর্ষণীয় এই উত্তর কি ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করছে আমরা তাই এখন দেখব। সরলভাবে দেখলে ব্রাহ্মণ এখানে শিল্পী ও দার্শনিক সমাজের প্রতিনিধি। বৃদ্ধা সাধারণ (প্রচলিত অর্থে) সংসারী জীবনের প্রতিনিধি। গল্পে বৃদ্ধাকে গঙ্গাস্নানে আগ্রহী দেখা গেছে। কিন্তু এমনও হতে পারত যে সে ধর্মকর্ম বিষয়ে মোটেই উৎসাহী নয়। সেদিক থেকে এ গল্পটি মাঝি ও পণ্ডিত গল্পের একটি প্রতিরূপ। তবে, গল্প-বলিয়ের পক্ষপাত এবার শিল্পী ও দার্শনিকদের প্রতি এবং তাই এবারে ব্রাহ্মণ একটি চমকপ্রদ উত্তরের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছে। দুঃখজনক ভাবে এই উত্তরের মাধ্যমে তার অপ্রতিষ্ঠিত হওয়ারও সুযোগটাও তৈরি হচ্ছে।
ব্রাহ্মণের উত্তর বৃদ্ধাকে অনুরূপ উত্তর প্রদানের সুযোগ করে দিচ্ছে। একই ভাষায় বৃদ্ধাও বাতিল করতে পারে ব্রাহ্মণকে: ‘চিন্তায় আমি সুখ পাই না, এমন সুখে আমার মন সুখী হতে চায় না’। ব্রাহ্মণের জগত ব্রাহ্মণের ভাষাতেই কি অপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়লো না? এবার ব্রাহ্মণকে ফু দিয়েই উড়িয়ে দেয়া সম্ভব৷ বৃদ্ধাকে সম্ভব হবে না; কারণ বৃদ্ধা যা অর্জন করছে তাতে সে দৃঢ় এবং নিশ্চিত। অথচ ব্রাহ্মণ যা অর্জন করতে চায় তা অপ্রত্যক্ষ ও অনিশ্চিত। ব্রাহ্মণ তাই নড়বড়ে এবং অস্থিতিশীল; অপরপক্ষে বৃদ্ধা দৃঢ় এবং স্থিতিশীল।
যারা শিল্প ও দর্শন সাধনায় নিয়োজিত তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণের ভাষাতে কথা বলার প্রবণতা রয়েছে, যা একটি অবস্থানকে মহৎ এবং অপরটিকে তুচ্ছ করে। ব্রাহ্মণের উত্তর কী হওয়া উচিত তা নিয়ে ভিন্নমতও থাকতে পারে। বলা যেতে পারে, জ্ঞানচর্চা হয়ত একধরণের অন্তর্গত প্রবৃত্তির ব্যাপার, যা কিছুটা হলেও দৈব-নিয়ন্ত্রিত। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির কিছু হয়ে উঠা বা না উঠার কৃতিত্ব ব্যক্তি দাবি করতে পারবে না। কিন্তু বিষয়টি যদি নির্বাচনের হয়ে থাকে তবে ব্যক্তি অবশ্যই তার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। চূড়ান্ত যেখানে অজানা সেখানে নির্বাচনের কৃতিত্ব দাবির ভিত্তি হতে পারে নির্বাচনের যুক্তি। আলোচ্য গল্পে ব্রাহ্মণ ও বৃদ্ধার বক্তব্য প্রতিসম হওয়ায় কোন এক পক্ষের নির্বাচনের কৃতিত্ব দাবি সম্ভব হবে না।
গল্প অনুসারে শিল্প ও দর্শনের সুখ নির্ভর করছে ব্যক্তিগত ভালো লাগা বা না লাগা বা ইচ্ছা- অনিচ্ছার উপর। কারো ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ আপত্তির বিষয় নাও হতে পারে। কিন্তু যদি দাবি করা হয় বিষয়টি বিশ্বাসের, প্রবৃত্তির কিংবা ব্যক্তিগত নয় বরং যুক্তি ও বিবেচনার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সার্বজনীন, তাহলে অবশ্যই আপত্তির কারণ থাকতে পারে। নানা বিভিন্নতার মধ্যেও জ্ঞানচর্চা কারীরা যে নিজস্ব মতবাদসমূহে অটল থাকতে পারেন, তা মনে হয় শেষমেশ বিশ্বাসগত অবস্থানকেই প্রকাশ করে থাকে।
গল্প চার : রাজার নতুন পোশাক
এবারের গল্পটি হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের একটি রূপকথা থেকে নেয়া হয়েছে। গল্পটি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো :
এক দেশে ছিল এক খেয়ালি রাজা। একদিন তার রাজ্যে দুই ধূর্ত তাঁতি এসে উপস্থিত হলো। তারা রাজাকে বলল যে তারা এমন এক ধরনের পোশাক বুনে দিতে চায় যা বোকা লোকেরা দেখতে পাবে না। রাজা খুশি হয়ে রাজি হলেন ও তাঁতিদের কাপড় বোনার জন্য প্রচুর অর্থ প্রদান করলেন। তাঁতিরা দিনরাত খটখট তাঁত বুনে চলল। রাজার লোকেরা কোন কাপড় দেখতে পায় না। তবু বোকা প্রমাণিত হবার ভয়ে তারা সবাই নতুন কাপড় ও তাঁতিদের প্রশংসা করে চলল। রাজাও একদিন দেখতে এসে কোন কাপড় দেখতে পেলেন না। তিনিও বোকা প্রমাণিত হবার ভয়ে অদৃশ্য কাপড়টি হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ প্রশংসা করলেন। তারপর একদিন রাজা নতুন কাপড়ের পোশাক পরে শোভাযাত্রায় বের হলেন। রাজ্যের লোকেরা রাজার গায়ে কোন পোশাক দেখতে পেলো না। তবু অন্যেরা বোকা বলবে এই ভেবে সবাই নতুন পোশাকের প্রশংসা করতে লাগল। রাজাও মহা খুশি ৷ এমন সময় এক ছোট ছেলে রাজাকে দেখতে এসে দেখল রাজার গায়ে পোশাক নাই। সে চেঁচিয়ে বলল, রাজা ন্যাংটা। শুনে বাকিরাও বলা শুরু করলো, রাজা ন্যাংটা। কথাটা রাজার কানেও পৌঁছালো। তিনি সব বুঝে তড়িঘড়ি করে প্রাসাদে ফিরে আসলেন।
তাঁতি দুজন ধূর্ত তা গল্পের প্রথমেই বলে নেয়া হয়েছে, তাই তারা প্রতারণা করবে এমনটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এমনও তো হতে পারত যে তারা দুজন সত্যিই কাপড় বুনেছিল যে কাপড় বোকা লোকেরা দেখতে পায় না। আর এই রাজ্যের সমস্ত লোকই বোকা, ছোট ছেলেটা সহ – তাই কেউই কাপড়টা দেখতে পায়নি। এ ধরনের ঘটনাও ঘটা সম্ভব। একটি নির্দিষ্ট গুণের অভাবে (যেমন ‘বোকামি’ হতে পারে বুদ্ধি বিবেচনার অভাব) একটি সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী কোন বিষয় সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। আমরা দেখতে পাই আকাশ আমাদের মাথার উপর নীল চাঁদোয়ার মতো বিছানো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা সূর্যের আলোর প্রতিফলন। আমাদের শ্রবণশক্তিও সীমাবদ্ধ। একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরের শব্দতরঙ্গ আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় গ্রহণে সমর্থ নয়। একটি চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যাবে গ্রীক রাজকন্যা কাসান্ড্রার উপাখ্যান থেকে। কাসান্ড্রা ছিলেন দেবতা আাপোলোর প্রেমিকা। আাপোলো তাকে ভবিষ্যদ্বাণী করার বর প্রদান করেন। পরবর্তীতে কোন কারণে আাপোলো কাসান্ড্রার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে সেই বর ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু
দেবতারা তাদের বর ফিরিয়ে নিতে পারেন না। তাই আ্যাপোলো কাসান্ড্রার ভবিষ্যদ্বাণীর কার্যক্ষমতা নষ্ট করার জন্য দ্বিতীয় বর প্রদান করেন। বরটি হলো কাসান্ড্রা সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে ঠিকই, কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করবে না। সে কারণে গ্রীস ও ট্রয়ের যুদ্ধের সময় কাসান্ড্রার ভবিষ্যদ্বাণী ট্রয়-বাসীরা বিশ্বাস করেনি।
এই গল্পটিকে এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতাকে প্রশ্ন-সাপেক্ষ করবে। যা বর্তমানে অপ্রত্যক্ষ তা ভবিষ্যতে প্রমাণিত ও প্রত্যক্ষ হতে পারে, কিন্তু যতদিন না হয় ততদিন আমাদের সিদ্ধান্তের প্রকৃতি কেমন হবে? আবার এমন কিছু প্রপঞ্চ থাকতে পারে, যার সর্বজন-গ্রহণযোগ্য প্রত্যক্ষতা নাও থাকতে পারে। যেমন শিল্পকর্মের শিল্পমূল্য ৷ প্রতিটি নতুন শিল্পকর্ম যেন গল্পের ঘটনাটিকে নতুন করে উপস্থাপিত করে। শিল্পকর্মটির দশা হয় রাজার নতুন পোশাকের মত, দর্শক কিংবা পাঠকের অবস্থান হয় আত্মবিশ্বাসী প্রজাদের মতো। শিল্পকর্মটির শিল্পমূল্য থাকা বা না থাকার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে দর্শক-পাঠকের প্রস্তুতি-অপ্রস্ততির প্রশ্নও। এ প্রশ্ন উত্থাপন করে অনেকে এর সুযোগও নিতে পারেন।
এরূপ সম্ভাবনা, বিবেচনা-বিশ্লেষণের এক সুবিশাল ও চমকপ্রদ ক্ষেত্রকে উন্মোচন করবে। কয়েকটি কৌতুকপ্রদ ঘটনা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। ধরা যাক, গল্পে বর্ণিত পোশাকটি নির্মাণের প্রশ্ন উঠেছে। সবাই জানে এধরনের একটি পোশাক তৈরি হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। ধরা যাক পোশাকটি তৈরি করে জনসম্মুখে পেশ করা হলো। যদি রাজ্যের সব লোক বুদ্ধিমান ও একজন বোকা হয়, তবে বোকা লোকটিও সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পোশাকটি দেখতে পাওয়ার কথা বলবে। যদি রাজ্যের সব লোক বোকা ও একজন বুদ্ধিমান হয় তবে সবাই তাকে মিথ্যাচারের দায়ে অভিযুক্ত করবে। বুদ্ধিমান লোকটি
প্রমাণিত বা প্রভাবশালী হলে ফলাফল অন্যরকম হতে পারে। আবার ধরা যাক, এক রাজ্যে একটি সর্বজনস্বীকৃত ও প্রমাণিত বুদ্ধিমান গোষ্ঠী আছে। গল্পে বর্ণিত পোশাকটি যদি নির্মিত হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তারা দেখতে পাবে। রাজ্যের বাকি প্রজারা পোশাকটি সম্পর্কে সিদ্ধান্তের জন্য তাদের নিয়োগ করল। পোশাক যদি তৈরি না হয়ে থাকে তবে তাঁতি দুজন এই গোষ্ঠীকে উৎকোচ প্রদানের চেষ্টা করবে। বুদ্ধিমান গোষ্ঠী অসৎ হলে উৎকোচ গ্রহণ করবে ও তাঁতিদের পক্ষে রায় প্রদান করবে। আবার পোশাক তৈরি হলেও বুদ্ধিমান গোষ্ঠী মিথ্যা রায় প্রদানের ভয় দেখিয়ে উৎকোচ আদায় করবে। উভয়ক্ষেত্রেই উৎকোচ বিনিময় ও তাঁতিদের পক্ষে রায় প্রদান হবে সাধারণ ঘটনা। একই পোশাক মনিব ও ভৃত্যের সামনে রাখা হলে ফলাফল হবে ভিন্নরকম। কোনো বুদ্ধিমান ভৃত্য তার মনিবের অহংকে অখুশি করার ঝুঁকি নিতে চাইবে না। যদি মনিব না দেখতে পায় তবে ভৃত্য দেখতে পেলেও না দেখার কথা বলবে। অপরদিকে মনিব যদি পোশাকটি দেখতে পাওয়ার কথা বলে তবে মনিব মিথ্যা বলতে পারে এ আশঙ্কায় ভৃত্য পোশাকটি না দেখার কথা বলাই নিরাপদ মনে করবে। তাই এক্ষেত্রে ভৃত্যের পোশাকটি না দেখতে পাওয়া হবে সাধারণ ঘটনা।
উপসংহার
উপরে যে আলোচনা হলো তা নিয়ে আরো কিছু বলার জন্য এই উপসংহার। বিশেষত প্রশ্ন উঠতে পারে পাশাপাশি এই চারটি গল্প কেন আলোচনা হলো তা নিয়ে। যে গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলা একই ধরনের নয়। আমাদের চারপাশকে ব্যাখ্যা করার মধ্যে কয়েক ধরনের প্রবণতা দেখা যাবে। যেমন, যারা বৈষয়িক জীবনের পথ (টাকা, বাড়ি ইত্যাদি) অনুসরণ করে থাকে তারা, যারা অবৈষয়িক জীবনের পথ (দর্শন, শিল্প ইত্যাদি) অনুসরণ করে থাকে তাদেরকে মনে করে অকেজো ও দুর্বল (প্রথম গল্প)। আবার বিপরীতটিও উপস্থিত (তৃতীয় গল্প)। দ্বিতীয় গল্পটি আমরা নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে কিভাবে খণ্ডিত আকারে ধারণ করে থাকি তার একটি আলোচনা। আমরা প্রায় সবসময়েই, নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে প্রচলিত গল্পগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিতে চাই। কিংবা গল্পকথার ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের মূল্যবোধের সৌধ? আমি খানিকটা সম্প্রসারিত বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিল দেখানোর চেষ্টার মধ্যে সমস্যা খুঁজে দেখতে চেয়েছি। আলোচনা অবশ্য শুধুমাত্র এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করছে চতুর্থ গল্পটি। আমাদের জীবনযাত্রা, বিশ্ববীক্ষা এবং সিদ্ধান্ত নির্ভর করে কিসের উপর? আমরা বর্তমানের অনেক কিছুকেই ফ্যাশন ও ভীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারব। কিন্তু আমাদের জ্ঞান-তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় ইতিহাস হিসেবে অবস্থান করছে প্রাচীন কিছু মনীষীর মতামত। তাদের বিশ্ববীক্ষা ভিন্নতর হলে তা. আমাদের বর্তমান বিশ্ববীক্ষাকে কতটুকু পরিবর্তন করত? জগত যেভাবে প্রতিভাত হচ্ছে তা কি ভিন্নভাবে প্রতিভাত হতে পারত?
বর্তমান আলোচনার এখানে সমাপ্তি টানছি।
ছবি:
Image by christian hardi from Pixabay
Image by Mystic Art Design from Pixabay
3 Comments
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
Fazilatun Nesa
অভিনন্দন
Nilufar Ghani
অনেক সুন্দর লেখা । প্রত্যেকটি গল্পের বিশ্লেষন ও মূল দর্শনকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ। এরকম লেখা আরও আশা করি।
Jannatul Ferdausi
good job