
টিয়া পাখি
ফ্ল্যাটবাড়ির জানালায় ঝুলন্ত খাঁচায় টিয়াপাখি। আমি ওকে কাঁচামরিচ দেই। কিন্তু সে খায় না। মরিচগুলি রোদে শুকিয়ে চটচট করে। পচে গন্ধ ছড়ায়। টিয়াপাখির গায়ের গন্ধের সাথে মরিচপচা গন্ধ মিলেমিশে যায়।
জানালার গ্রিল থেকে ঝুলছে খাঁচাটি। বাইরে দূরে গলির অন্যপাশে আমগাছ। ডানদিকে গার্মেন্টসের ছাদ। আমার টিয়াপাখি মরিচ খায় না। চাল খায় না। শুধু পানি খায়। পানি খেতে খেতে শুকিয়ে ছোট হতে থাকে।
অগত্যা একদিন খাঁচার দরজা খুলে দেয়া হলো। পাখিটা আস্তে আস্তে হেঁটে এলো। মাথা গলিয়ে বাইরে তাকালো। তারপর হাওয়ায় ভেসে দূরে আমগাছের ডিরেকশনে উড়ে গেল।
আমগাছে মুকুল আর চাপা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ভূতেরগলির আকাশে কোথাও শেষবারের মতো আমি আমার টিয়াপাখিটিকে দেখেছি উড়ে যেতে। নালার পাশে ভূতেরগলি। হাওয়াইমিঠাই বেচা ফেরিওয়ালার ডাক। কটকটিওয়ালার ডাক। মাগরিবের আগে আগে ঝিমধরা সন্ধ্যাবেলা।
অন্ধকারে জোনাক জ্বলতেছে। কতগুলি চোখ জ্বলতেছে এখানে ওখানে। সন্ধ্যাতারার মতো তীক্ষ্ণ ও ম্লান। ভূতেরগলির আমগাছ। বাঁকা ভুরু। ধাঁরালো গ্রীবা। চোখের পাপড়ি তুলে অল্প তাকিয়ে আলগোছে ঘুরিয়ে নেয়া।
ঠাণ্ডা কাঠের মেঝে। কার্পেটের কিনারে উলের টেক্সচারে কতগুলি মানুষের মুখ ভেসে আছে। জ্বালপড়া দুধের মতো ফুলে উঠতেছে। তারপর আবার মিশে যাচ্ছে কার্পেটের গায়ে। উলের টেক্সচারে।
কাচা মরিচের তীব্র গন্ধ। টিয়াপাখির ঠোঁট। খাঁচার তারগুলো ধরে কামড়াচ্ছে। জানালার গ্রিল থেকে ঝুলছে খাঁচাটি। বাইরে আমগাছ আর শত শত মানুষ। অন্ধকার খোলামাঠে আকাশের দিকে মুখ করে চিৎকার করে কাঁদতেছে। গলার রগ ফুলে আছে সবার। চোয়াল ঝুলে আছে। কাতারে কাতারে মানুষ। যন্ত্রণায় চিৎকার করে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও টু শব্দ নাই। শুনশান নীরবতা।
ভিড়ের ভিতর আফ্রিকান টোটেমের মতো লম্বাটে কিছু মুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাথায় চাদর মুড়ে। পুলিশের মতো টহল দিচ্ছে। ঘোমটা তুলে ক্রুর চোখে তাকাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। ভুরু কুচকে।
এই মহাজাগতিক অন্ধকার। তার ভিতর কালচে নীল ভূতেরগলি। তোবড়ানো সিমেন্টের পেভমেন্ট। শ্যাওলা ধরা দেয়াল। ইলেকশনের রঙিন পোস্টার। অমস্মৃণ। মাগরিবের সময়কার গভীর কোনো আমগাছের কোষ দিয়ে তৈরি। ভয়াল মুখ। করোটি। চোয়ালের হা।
আমার দিকে তর্জনি তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হায়নার মতো তেড়ে এসে নাকের ডগায় বিকট ভঙ্গিতে লাফাতে লাগলো। লাফাতে লাফাতে আচমকা শান্ত হয়ে কোমলভাবে হেসে ঢেউয়ের ধাক্কা লাগা বালুর প্রাসাদের মতো ঝুরঝুর করে ভেঙে গলে মিলিয়ে গেল কার্পেটের উলের ভিতরে।
আমি চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম। আলো আসতেছে। অন্ধকার আসতেছে। কতগুলি পোকা আসতেছে। নিয়মানুবর্তী সুঠাম মাংসে সন্নিবেশিত হাত-পা। টেন্ডন। এই আমার ঘাড়। ঘাড়ের উপর এই আমার মাথা। করোটি। এইখানে পদ্মাসন। গাঢ় নীল সন্ধ্যাবেলা। কাতারে কাতারে মানুষ। চলন্ত লাভার মতো মন্থর। ক্ষীণ কান্নার সুর। কল্পনার সুর। শত শত। হাজার হাজার। কত মানুষ তার ইয়ত্তা নাই। সবার পরনে একই যন্ত্রণার ছাপ। ফুলের পাপড়ির মতো আনত ফ্ল্যাটবাড়ির জানালা। ঝুলন্ত খাঁচায় টিয়াপাখি। যেখানে মরিচগুলি রোদে শুকিয়ে চটচট করে।
2 Comments
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
SHABBIR AHAMED
কবি আপনাকে শুভকামনা জানাই
SHABBIR AHAMED
কবি আপনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই