‘নতুন কবি স্মরণে’ বইটির ভুমিকা থেকে
মুখবন্ধ
এ কাহিনী আমার নয়। আমার বন্ধু জুঁইফুল চৌধুরীর। জুঁইফুল চৌধুরীকে আপনারা হয়তো অনেকে চেনেন, অনেকে চেনেন না। জুঁইফুল চৌধুরী গত ত্রিশ বছর ধরে সাহিত্যের সেবা করে আসছে। সেবা কথাটা বোধহয় অতিশয়োক্তি হলো। কেন না কথাটার মধ্যে একটা নিঃস্বার্থ দানের ইঙ্গিত উহ্য আছে। জুঁইফুল চৌধুরীর সেবার মধ্যে প্রত্যাশা ছিল। নাম, অর্থ ও প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা। যা সকল মানুষের মধ্যেই উগ্রভাবে বর্তমান থাকে। মানুষ নিজেকে সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চায় না। ছড়িয়ে দিতে চায় অনেকের মধ্যে। জুঁইফুল চৌধুরী পারেনি। নাম, প্রতিষ্ঠা, অর্থ কিছুই তেমন করে অর্জন করতে পারেনি। শুধু একটানা ত্রিশ বছরের পরিশ্রমের হতোদ্যম তার শরীর ও মনকে ক্লান্ত ও বিষণ্ণ করেছে। তাই বলছিলাম জুঁইফুল চৌধুরীকে আপনারা হয়তো অনেকে চেনেন, অনেকে চেনেন না। জনপ্রিয়তা দিয়ে তো আজকাল মানুষের পরিমাপ হয়। জুঁইফুল চৌধুরী জনপ্রিয়তা পায়নি। এ কাহিনীর পর যদি সে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পায়, তাহলে বুঝতে হবে অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া কিছু নয় এবং সুবিস্তৃত বাংলাদেশে এইটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ কাহিনী জুঁইফুল চৌধুরীর নিজের লেখার কথা। কিন্ত ও আর লিখবে না, কোনোদিন লিখতে পারবে না। আমি ওর শৈশবের বন্ধু। শেষ পর্যন্ত দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হলো। বিশেষ করে ওর ছেলেমেয়ের কথা ভেবে। তের বছরের একটি ছেলে ও বার বছরের মেয়ে আছে ওর। এবং তার ভবিষ্যৎ আছে। এ বই যদি বিক্রি হয়, যদি টাকা আসে, তাহলে জুঁইফুল চৌধুরীর অনেক পুরনো লেখারই হয়তো কাটতি হবে এবং তাতে তার ছেলেমেয়ের উপকার হবে। তারা মানুষ হতে পারবে, লেখাপড়া শিখতে পারবে। এসব সাত-পাঁচ ভেবে আমি লিখতে বসেছি। অবশ্যই লেখা আমার নেশা বা পেশা কোনোটাই নয়। সুতরাং লেখায় শিল্পের অভাব পেলে ক্ষমা করবেন।
আমার ছাত্র মহিয়ান
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পথে নেমে এলাম আমি। বাস স্টপে এসে দাঁড়ালাম। প্রত্যেকেটি বাসেই উপচে পড়া ভিড়। বাসের থেকে কেউ আমাকে দেখছে কিনা তা আমি দেখছিলাম। কোনোও বাসে ওঠার চেষ্টাই করছিলাম না। আর করেও কোনো লাভ নেই। আমি এই ভিড় বাসে কোনো দিনই উঠতে পারি না। ভিড়ে ছিটকে যাবে আমার কাঁধের ব্যাগ। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পায়ে ব্যথা হয়ে যায়। তবুও দাঁড়িয়ে থাকি। একবার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম। না প্রথম ক্লাসটা বুঝি নেওয়া গেল না।
হঠাৎ একটা সিএনজি এসে দাঁড়াল বাস স্টপে। বাঁ দিকে দরজাটা খুলে দিয়ে ছেলেটি বলল ‘চলে আসেন স্যার’। আমি একটু যেন অবাক হয়ে গেলাম। পিছনের গাড়ির হর্ণের শব্দে কিছু শোনা যাছিল না। একটু নিচু হয়ে সিএনজির ভিতরে আবার তাকালাম আমি, সত্যিই কি আমাকেই ডাকছে সিএনজিতে বসে থাকা ভদ্রলোক।
আবার বলল ‘চলে আসেন স্যার’। আমি আর দেরি না করে শরীরটা ঢুকিয়ে দিলাম সিএনজির ভিতরে। আমি অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করল ‘কি হলো স্যার, আমায় চিনতে পারছেন না?’ মোড়ে সিএনজিটাকে টার্ণ নিয়ে বলল, ‘আমি আপনার ছাত্র মহিয়ান, মহিয়ান চৌধুরী। সবাই আমাকে মহান বলে ডাকতো। ছোটবেলায় মৈমনসিংহের স্কুলে পড়েছি। মৈমনসিং বাজারের সব চাইতে বড় ও জনপ্রিয় স্টেশনারি দোকানটি ছিল আমাদের। আমি লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিলাম না। কোনোদিনই দশজনের মধ্যে হতে পারিনি স্যার। আসলে চিরকাল লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র মহিয়ান। সব শিক্ষককে হতাশ করেছি আমি।’
অবশেষে আমি না বলে পারলাম নাঃ একদিন তো আমি ভাড়া দিতে পারি। ও বলেছিল : স্যার তা কি হয়, আপনাকে অনেকদিন কাছে পেলাম, এটাই তো আমার অনেক পাওয়া। আপনি সবসময়ই অনারেবল গেস্ট। এমনি করে প্রতিদিন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে গন্তব্য থেকে ফেরা, ফেরা থেকে গন্তব্য করি।
চাকরি চলে যাওয়ার পর
সিএনজি থেকে নামলাম অফিসে। দু-তিনজন পরিচিত অফিসারদের সঙ্গে দেখা হতেই তারা পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। আমি হেসে কথা বলার চেষ্টাও করলাম। কিন্ত কেউ তেমন পাত্তাও দিলেন না, গেটে দায়োয়ানরা দাঁড়িয়ে ছিল, আমার সামনেই, যারা দারোয়ানদের সামনে দিয়ে ঢুকছিলেন, দারোয়ান তাদের প্রত্যেককে স্যালুট করল। কিন্ত আমাকে তা করল না। হয়তো করেছে, নয়তো করবে ভেবে আমি দারোয়ানদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিন্ত কোথায়! সকলে মুখ ফিরিয়ে সরে গেল। নিজের কাজে মন দিল।
লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সকলকে প্রায় ডিঙিয়ে প্রথমেই লিফটে উঠতে যাবো ভেবেছিলাম, কিন্ত লিফটম্যান বলে উঠলো, ‘সরে যান, প্রথমে অফিসার লোককে চড়তে দেন?’
এবার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল আমার, কেন আমি কি অফিসার নই তবে? আমি তো ওদের থেকে সিনিয়র!
অগত্যা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো। উঠে হাঁপিয়ে গেলাম আমি। নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমার ঘরের দরজায় নেম প্লেটটা তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আরেকজনের নাম। ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম। দরজায় একজন ষণ্ডা-মার্কা লোক বসে আছেন। জোর করে ঢুকতে গেলাম, ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। কান্না পেয়ে গেল। কেঁদে ফেললাম আমি। কেঁদে উঠলাম, সত্যি সত্যি কেঁদে উঠলাম। আমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে লাগলাম কিন্ত এই কান্না যে অরণ্যে রোদন সে কথা আমি জানি না, জানতে চাই না। কেউ আমার চোখের পানির মূল্য দিতে আজ আর রাজি নয়।
রোশেনারা
তুমি কতো কথাই তো কতোবার বলেছো, আমার তা শুনতে কোনোদিন একটুও খারাপ লাগেনি।
ভালো লেগেছে। আজও লাগবে। তোমার কথাই তো আমি শুনতে চাই।
তুমি পুরনো কথা ফিরিয়ে আনো, পুরনো দিগগুলিকে ফিরিয়ে আনতে পারো না?
এক একটা দিনকে ফিরিয়ে এনে থামিয়ে রাখতে পারো না?
তুমি বিয়ে করো না, তবেই তো সে দিনগুলি ফিরে আসবে।
ফুরিয়ে যাবে, আবার ফিরে আসবে। থেমে না হয় না-ই রইল। রোশেনারা, তুমি বিয়ে করো না।
রোশেনারা, তুমি কিছুতেই বিয়ে করো না। এক অর্থহীন সনির্বদ্ধ অনুরোধ।
আমার দুচোখে অনুনয়, প্রত্যাশা।
.
.
.
Page top image (modified). Original by Nicole Burkart from Pixabay
5 Comments
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
Drako Shajib
জীবনের কত শত অধ্যায়! পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠি কখনোবা, তাঁতিয়ে উঠি! তবুও কে যেন লিখে চলেছে গল্পগুলো আমার হয়ে আমারি জন্যে। শুভেচ্ছা নেবেন!
মোঃ আরিফুল ইসলাম
হৃদয়টা অস্থির হয়ে উঠল
ছোট ছোট গল্পের ছলে অনেক না বলা কথা!
ভাস্কর
গল্লপ হতে হতে কবিতা হয়ে যাচ্ছে যেন। অপূর্ব ভাষা। অন্যরকম।
Neel tripura
বেশ ভাল কিছু টুকরো লেখা। খুব ভাল লাগল।