বই মেলাতে

বই মেলাতে

বই মেলাতে গেলাম গত সন্ধ্যায় সোমার সাথে। সুজন এক পুলিশের কাছে সৌজন্যমূলক মাফ টাফ চেয়ে ঢুকলাম বেরোনোর পথ দিয়ে। গেছিলাম দোয়েল চত্বরের দিক থেকে। বেরোনোর পথ দিয়ে ঢুকতে না পারলে, লম্বা ঘুর পথে যেতে হতো টি.এস.সি অব্ধি এবং দাঁড়াতে হতো লম্বা লাইনে। চোট্টামানি করলাম। লেখালেখির সম্মানী পাই না, কপিরাইটের কোনো বাপ-মা নাই, এই চোট্টামানি-টা মাফ করে দিয়েন।

প্রথমে গেলাম আমার ‘জুলেখা ট্রিলজি’র প্রকাশক জাগৃতির স্টলে। ওখান থেকে বন্ধু লিটুর অনুদিত ‘ইরাকের রাত’ কিনলাম। সৌষ্ঠবের দিক থেকে বইটা মেলার সেরা বই হিশেবে পুরস্কৃত হবার যোগ্য, আবার অনুবাদেও তাজা বৃষ্টি ভেজা ঘাসের গন্ধ।

সৈয়দ আনোয়ারা হকের সাথে

জাগৃতির উল্টো পাশে বন্ধু তারিক সুজাতের জার্নিম্যান স্টল। তারিকের স্ত্রী মিমির ডাকে স্টলের ভেতরে গেলাম। ওখানে চুমকিকে পেয়ে মন ভরে গেলো। চুমকির সাথে খুচরো আলাপ অনেক দিনের, মাঝখানে একবার কি এক কথায় ঢাকাই গালাগাল দিয়ে বসেছিলাম। চুমকি কথা বন্ধ করে দিয়েছিল, দেখা হতেই আবার আগের মতো যেই কে সেই। একই স্টলে বসে ছিলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক, ওনার সাথে আমার জমে গেলো এবং তার সুবাদে মিমি আমাকে, সোমাকে ওনার একটা সমগ্র পুশ সেল করতে চাইলো। সেটা আর কেনা হলো না, দাম অনেক বেশি। তাতে আনোয়ারা আপা ক্ষুণ্ণ হন নাই, আমাদের ওয়ান-টু-ওয়ান আলাপচারীতাও ব্যাহত হলো না। আনোয়ারা বেগম চৌধুরীর, “সৈয়দ হক” উপাধিতে আমার আপত্তির কথা জানালাম। উনি তখন বিয়ের পরপর তারকা সৈয়দ হকের আহ্লাদে সাড়া দিয়ে তা মেনে নেয়ার কথা জানালেন। প্রসঙ্গত জানালাম যে, এতে করে লেখালেখিতে ওনার স্বাতন্ত্র্যের খোড়াখোড়ির চেয়ে তুলনামূলক ছায়াপাত চলে আসার সম্ভাবনা আছে, যেখানে ওনার লৈখিক ম্যানারিসম একেবারেই আলাদা। আমার বই উল্টেপাল্টে জানালেন, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের কেবিনে ১৯৬৫-তে আমার ও যমজ বোনের জন্মের সময় উনি গাইনি ছিলেন। সে সময় নাকি বিভিন্ন বিভাগীয় চিকিৎসক আমাদের দেখাতে তাদের ছাত্রদের ঐ কেবিনে নিয়ে এসেছিলো। হতে পারে তরুণী চিকিৎসক আনোয়ারা বেগমও তাদের একজন ছিলেন।

ঘুরতে, ঘুরতে পেলাম প্রয়াত আবিদ আজাদ প্রতিষ্ঠিত শিল্পতরু প্রকাশনীর স্টল। খুবই করুন বেহাল অবস্থা। পুরানো কর্মচারী খোকন জানালো, আবিদ ভাইর ছেলে তাইমুর কোনভাবে প্রকাশনীটা টেনে নিচ্ছে। শত এক-ঘরে অবস্থাতেও আবিদ ভাইয়ের হাত দিয়ে যেসব সমীহ জাগানো প্রকাশনা বেরিয়ে এসেছিলো, তার ছিটেফোঁটা অস্তিত্বের ভেতর কেবল আবিদ আজাদ সমগ্রটা উঁকি দিচ্ছে আবে-তাবে প্রকাশনার ভেতর। সেটাই আবারও কিনলাম কাউকে উপহার দিতে। স্টলটাকে দেখে ছোটবেলার নিউমার্কেটের নোভেল আইসক্রিম পার্লারের কথা মনে পড়ল!

বাংলা একাডেমি সাইডে সব কিছু খোলা, বন্ধ কেবল কপিরাইট দফতরের স্টল-টা

কেনাকাটি শেষ করে স্বাধীনতা স্তম্ভ ঘেরা লেকের পাশে বসে একটু হাফ ছাড়তে চাইলাম। কিন্তু বসনেওয়ালারা কেউ আর উঠতে চায় না। লেকের তিন ভাগ মজবুত টিনের দেয়ালে ঘিরে পুলিশি প্রহরায় বইমেলা থেকে আলাদা করা হয়েছে। লেকটা ঘিরে বইমেলা করলে ভালো হতো। আবার লেকের পানি ময়লা হবারও সম্ভাবনা। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের অন্যপাশগুলো দিয়ে অবশ্য লেক খোলা। নদীমাতৃক বাঙ্গালির পানি নিয়ে অনীহাটা আবার মনে পড়ল।

রাস্তা পার হয়ে গেলাম বাংলা একাডেমি সাইডে। এ মেলার পত্তনি করা মুক্তধারার স্টলটিকে একাডেমি সাইডে রাখাটাকে খুব সাধুবাদ জানাই। তবে মুক্তধারার বইপত্রে আগের সাহসিকতার লেশমাত্র পাওয়া গেল না। পুরনো মাস্তানদের ভেতর সত্যেন সেনের বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখলাম। বাংলা একাডেমি সাইডে সব কিছু খোলা, বন্ধ কেবল কপিরাইট দফতরের স্টল-টা। এই বন্ধ থাকাটা লেখকের কপিরাইটের ব্যাপারে আমাদের অন্ধত্বের নির্দেশক। প্রকাশকেরা লেখককে লোপাট করে দিয়েছে। সদ্য গঠিত প্রকাশনী ‘পেন্সিল’ এবার একবারে বের করেছে ৫০টার ওপরে বই। বুঝুন ঠেলা।

সোহাগের সাথে শীঘ্রই বন্ধুত্ব হয়ে গেলো

ওহ, এর ভেতর এক স্টলের সামনে একজন সুদর্শনা জিজ্ঞেস করলেন, আমি চয়ন খায়রুল কি না? হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিতে জানালেন, ওনার তিন, চারটা বই বেরিয়েছে, সেগুলো কোন স্টলে পাওয়া যাবে। আমি কেমন আছি, আমার কিছু বেরিয়েছে কি না, এসব সুধালেন না। পাজামা, পাঞ্জাবি পরা চশমা চোখের এক ছিপছিপে তরুণও এসে জিজ্ঞেস করলো আমি আমি কি না? আমি যে আমি, সেটা জানাতে তরুণ জানালো যে ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র। নাম সোহাগ। সোহাগের সাথে শীঘ্রই বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। সোমা আর আমি ওকে একসাথে হাঁটার নিমন্ত্রণ জানালাম। সোহাগের সাথে আমার কিছু ছবি তুলল সোমা। আমরা দুইজনই একটু বেশি ফর্সা হওয়াতে কথিত লিটেল ম্যাগ চত্বরের উজ্জ্বল আলোতে ছবি তুলতে বেশ বেগ পেতে হলো। এত আলোতেও লিটেল ম্যাগ চত্বর একেবারেই নিষ্প্রাণ, ম্যাড়মেড়ে। গোরস্থানের কাফন, আগরবাতির দোকানও এর চেয়ে জীবন্ত। কয়েক শ ছোট দোকানে, কয়েক হাজার অ-বিচিত্র বই নিয়ে বসে আছে কথিত লিটেল ম্যাগের ঢাকাই বেনিয়াদের গরীব আত্মীয়-স্বজনেরা। আমাদের সমকালীন দু’জন পুরনো লিটেল ম্যাগ সম্পাদকের জীবন, জীবিকা মনে পড়ল। এক ঘনিষ্ঠ অনুজ আমার কাছে এসে এবং বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতেও ইদানীং ‘বহেরাতলা’ ইত্যাদি বলে জায়গাটার মাহাত্ম্য বাড়াতে চেয়েছে। পুরো ব্যাপারটা মনে হলো পুরনো বামপন্থী রাজনীতির “বিশ জনকে দেখিয়ে এক জনকে আড়াল করার” খেলা। সোহাগ সাথে না থাকলে এ জায়গাটা আমাকে অবসাদগ্রস্ত করে ফেলত।

কিছুদিন আগে বইমেলা ঘুরে যাওয়া পাপিয়ার কথা মনে পড়ল। মেলাটাকে এত ভিড়েও নিঃসঙ্গ মনে হলো। একাডেমি নির্ধারিত ভবনের ক্যান্টিনে গেলাম। দেদার খাবার দাবার বিক্রি হচ্ছে আস্তাকুড়ের ময়লার ভেতর।ব্যবস্থাপক জানালো সবশেষে গরম পানি দিয়ে ধোয়া হবে। মানে, যার যা খাবার ঐ নোংরা জঞ্জালের ভেতর খেতে হবে। বাবা মা-দের দেখলাম বাধ্য হয়েই ওখানে ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের এটা সেটা খাওয়াতে। এই শহরেই কনভেনশান সেন্টারের ক্যান্টিনগুলো কী ধোপদুরস্ত। বিক্রেতাদের একজন জিজ্ঞেস করলো আমি লেখক কি না, লেখক হলে কফিতে ডিসকাউন্ট পাবো। কী উত্তর দেবো, বুঝতে পারলাম না। বোঝা-না-বোঝার অমীমাংসিত সীমান্ত পার হয়ে একাডেমি থেকে বের হয়ে ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে গেলাম। লেখালেখি চালানোর এত প্রণোদনায় আহ্লাদিত হওয়া ছাড়া আর যে কোনো উপায় নাই, তা লেখাই বাহুল্য!

ঢোকার মুখে দেখা হওয়া, কাঠের ঠ্যালাগাড়িতে বই পারাপার করা ছোট্ট ফেরিওয়ালাটিকে খুঁজলাম। পেলাম না। ওকে খুঁজতে আবার বার বার বইমেলাতে যাব।

বই পড়ুন। কিনে পড়ুন। রয়্যালটি আদায়ে লেখকেরা সোচ্চার হউন।

চয়ন খায়রুল হাবিব
২৪/০২/২০১৯
বনানী, ঢাকা

কাঠের ঠ্যালাগাড়িতে বই পারাপার করা ছোট্ট ফেরিওয়ালা

page top image: Ashfaq Mahmud, CC BY-SA 3.0, via Wikimedia Commons
বাকী সব ছবি গুলি লেখকের নিজের ব্যক্তিগত সংরহ

Loading

6 Comments

  1. সুন্দর

  2. বই মেলায় ঘুরতে যাওয়া বা বই কিনতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার খুব বেশী নাই। তারপরেও বেশ কিছু জায়গায় এসে বেশ কিছু ভাবনার মিল খুঁজে পেলাম লেখকের অভিজ্ঞতার সাথে। আশা করি ঘুরতে ঘুরতে সোহাগের মত আমারো দেখা হয়ে যাবে আপনার সাথে। সেই পর্যন্ত ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা নেবেন!

  3. ভালো লাগলো পড়ে

  4. আমার সুন্দর মনের কবি সাহিত্যিক বন্ধুদের’কে জানাই শীতের পিঠা ও নকশীকাঁথা’র শুভেচ্ছা ও সালাম… আমার সাম্প্রতিকতম বিশ্বসাহিত্যের নারী কবি ও সাহিত্যিক পরিচিতিমূলক লেখা “কন্যাকবি” ধারাবাহিকের তৃতীয় কবি “ম্যেরিনা স্বেতায়্যেভা”, প্রেম ও মুগ্ধতা’র শব্দিতা “প্রণয় ক্ষণিকা” ধারাবাহিক বিশ্বসংগীত বিষয়ক লেখা “একটি গান – সহস্র মুগ্ধতা – [৪], সাম্প্রতিকতম পাঠকপ্রিয় কবিতা  “আগুন জোনাকি” এবং আমার প্রোফাইলে লিংককৃত আমার পূর্বের কবিতাসমূহ পাঠের আমন্ত্রণ ও আহ্বান জানাই… সকলেরই কবিতার প্রতি প্রেম হোক, কবি’র প্রতি প্রেম হোক… শুভ হোক…

  5. সুন্দর শুভকামনা

  6. চমৎকার লাগল। বই কেনা ও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বেশী করে জাগিয়ে তুলতে হবে।

Leave a Reply

Skip to toolbar