
বেগমবাগ
আজকাল সবকিছু ঝাপসা না হলে নুরুল সত্যটা বলতে পারে না। চারপাশটা ঝাপসে হতে তার অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ ১৬৮ ঘণ্টা।
সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন লাঞ্চের পর থেকে কিছুতেই তার অফিসে মন টেকে না। খাবারও ঠিকমতো খায় না। পেট ভরা থাকলে যদি ঝাপসা কম হয়!
আকাশটা আজ অভিমানী প্রেমিকার মুখের মতো অন্ধকার। নুরুলের বুক দুরু দুরু করে। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। এই সময়ে রাস্তায় খুব জ্যাম থাকে। সঙ্গে ছাতা নেই। ভিজে গেলে নির্ঘাত জ্বরে ধরবে।
পাশের ডেস্কের মলি রোদছাতা ব্যবহার করে। ওকে পটাতে পারলে এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে মলি হঠাৎ তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মিষ্টি একটা হাসি দেয়ায় সুযোগটা সে খাবলে নেয়।
ঠিক পৌনে ৪টায় নুরুল অফিস থেকে বেড় হয় একটা গোলাপি ছাতা হাতে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ভিড়ে কারও সঙ্গে ধাক্কা লাগলে ঘাম শরীরে আরও লেপটে মিশে।
এখনই এতো মানুষ! সবারই উদ্দেশ্য কী তার মতো কিনা ভেবে সে মুচকি হাসে। বাস স্ট্যান্ডে নেই। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে সবাই উঠে পরে। নুরুল দাঁড়িয়ে থাকে।
বৃষ্টি বাড়ে। একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়ায় সে। হাতের ছাতা এই উল্টোয় তো সেই উল্টোয়। গাড়িগুলো থরে-বিথরে থমকে।
হর্নের এলোমেলো শব্দ যেন সাত আসমান ভেদ করে ঈশ্বরকে নামিয়ে আনার প্রতিযোগিতায় মেতেছে।
হাতঘড়িতে পৌনে ৫টা। নুরুল আবারও হাটতে শুরু করে। রাহাত বলেছে, আজ স্পেশাল কাবাব খাওয়াবে। ইতালি থেকে বন্ধু আসিফ আসছে। এরমধ্যে মনিরের জমিয়ে রাখা একগাদা কবিতার প্রলাপও শুনতে হবে ভেবে আনমনেই কপালে ভাজ পড়ে।
হঠাৎ কাঁধে হাত। ঘুরে তাকাতেই রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে চশমাচোখে তার দিকে মুখ আলো করে তাকিয়ে আছে কাকভেজা এক মেয়ে। চিনতে গিয়ে কয়েকটা পলক পড়ে। বাড়িওয়ালার মেয়ে সানজানা।
মনিরের কাছে শুনেছে বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েদের নাকি অপ্সরীর মতো লাগে। কিন্তু নুরুলের কখনও তা মনে হয়নি। বরং ভেজা চুল বরাবরই তার কাছে নেতানো ঘাস।
তবে গলার ভাজে ভাজে জমা বৃষ্টির ফোটা, ঘাম তাকে দুর্বল করে। নারীর ভেজা শরীরের গন্ধ তাকে আদিমতার ঘোর ধরায়।
ছোটবেলায় স্নান শেষে মা ফিরলে নুরুল তাকে খুব করে জড়িয়ে ধরত, মনে পড়ে চোখ ভিজে উঠে তার।
সানজানার ডাকে হুঁশ ফেরে। ফুটপাতের এককোণে চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারা। সানজানা একচেটিয়া বলেই চলে।
লিকলিকে গড়নের এই কলেজ পড়ুয়ার দিকে এর আগে কখনও তেমন খেয়াল করেনি। দুইবেণী ঝুলিয়ে বইয়ের বোঝা নিয়ে শুধু আসতে-যেতেই দেখেছে সবসময়।
নুরুল লক্ষ্য করে জব জবে ভেজা এই ফ্যাকাসে ফর্সা মেয়েটাকে দেখতে খারাপ লাগছে না। খোলা চুল বেয়ে পড়া জল যেন খরস্রোতা এক ঝরনা। পরম শান্তি খুঁজতে যে আছড়ে পরছে নদীর বুকে।
বৃষ্টি কমেছে। চার কাপ চা শেষ করে এক ছাতার নিচে হাঁটতে থাকে দুজন। কিছুটা সামনে গিয়েই বাস মেলে। হাতঘড়িতে পৌনে ৬টা।
কন্ডাক্টর কিছুতেই সানজানাকে বাসে উঠতে দিতে চায় না। অনেক অনুনয়-বিনয় করে সফল হয় তারা। সানজানাকে মহিলা সিটের সামনে রেখে নুরুল পিছে দাঁড়ায়।
আশপাশের লোকজন ত্রাণের চাল চুরি থেকে ফেসবুক কী করে ঘরের ঝি বৌদের নষ্ট করছে সে প্রসঙ্গ ছাপিয়ে সামনের ইলেকশনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হবে তা নিয়ে বিশ্লেষণী আলোচনায় মত্ত। নুরুল মন দিয়ে সব শোনে। কিছু বলে না।
রুমন এসেছে কি না কে জানে। বলেছিল ৩ মাসের বকেয়া বেতন আজ পাবে। একটা জম্পেস ট্রিট হবে। ধারের টাকাটাও ফেরত দিবে। শেষ মুহূর্তে অফিস থেকে এসাইনমেন্ট না দিলেই হয়। সাংবাদিকদের তো আবার কিছুই ঠিক থাকে না।
এর মধ্যে সামনের স্টেশন থেকেও লোক উঠে। কমলা গেঞ্জি পরা মাঝবয়সী দাড়িওয়ালা এক লোক সানজানার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ায়।
সানজানা সরতে বললে দাড়িওয়ালা মাঝবয়েসী ঝারি মারে। আশপাশ থেকে সবাই হই হই করে উঠে লোকটার হয়ে। সানজানা চোখ নামিয়ে নেয়।
দাড়িওয়ালা মাঝবয়েসীর সাহস আরও বাড়ে। মেয়েছেলেদের এতো ভিড়ে গাড়িতে উঠা ঠিক না বলে নানা নসিহত দিতে শুরু করে।
নুরুলের ভ্রু কুচকে যায়। সে দেখে কথার ফাঁকেই মাঝবয়েসী দাড়িওয়ালার একটা হাত সানজানার পিঠ ছুঁয়ে বাহুর নিচ দিয়ে সুড়সুড় করে এগিয়ে খপ করে তার শরীরের একটা মাংসল অংশ চাপ দিয়ে ধরে।
নুরুলের চোয়াল শক্ত হয়। হাতঘড়িতে পৌনে ৭টা। বেগমবাগ চলে এসেছে। সানজানার অসহায় চোখ এবার চিৎকার করে নুরুলকে ডাকে। নুরুলের শ্বাস দীর্ঘ হয়। অসার হয়ে যাওয়া পা টেনে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে দ্রুত সে নেমে যায়।
একটি আলো-ঝলমলে ফাইভ স্টার হোটেলের বিপরীত গলির আলো-আধারিতে নুরুল ধীরে ধীরে তার গন্তব্যে হারিয়ে যায়।
আসলে আজকাল সবকিছু ঝাপসা না হলে নুরুল সত্যটা বলতে পারে না। তাই প্রতিবাদটাও করতে পারে না।
10 Comments
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
Ashaduzzaman-Khokon
তাই
SHABBIR AHAMED
কবি ভাল কাব্য বর্ণনা করেছেন!
Md. Manirul Islam Monir
খুব ভালো
ইসলাম মুহাম্মদ তৌহিদ
ভালো লাগল
অরিন্দম সাইফুল্লাহ
আাপনি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে যে কাপুরষতাকে ইঙ্গিত দিলেন, স্রষ্টা আমাদের সে কাপুরুষতা উপেক্ষা করে পুরুষ করে তুলুন! আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর লেখনীর জন্য!
Rustum Ali
লেখাটি পড়ে নিজেকে ধন্য মনে হলো
Rustum Ali
লেখাটি পড়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
Rustum Ali
অসাধারণ লেখা।
Rustum Ali
দারুণ হয়েছে। ধন্যবাদ।
Drako Shajib
প্রতিবাদ না করে পালিয়ে যাওয়া নুরুলের জন্য কষ্ট হচ্ছে। মানুষের মনের আধারে আলোর সঞ্চার হোক।❤️