শাহীন আপা

শাহীন আপা

“আর তাছাড়া ১৪/১৫ বছর তো অনেক লম্বা সময় আর আমরা দুইজন তো আগের দুইজন নেই।”

চারপাশে বড় বড় কলোনি বাড়ির মধ্যে আমরা তৈরি করে নিয়েছি আমাদের ‘কৃষ্ণচূড়া চত্বর’। একটা বিল্ডিংয়ের পেছনে খালি পড়ে থাকা জংলা জায়গা পরিষ্কার করে, চারপাশে বেড়া দিয়ে, বেড়ার ভিতরের পাশে লাইন ধরে লাগানো বিভিন্ন ধরনের কুল গাছ। এছাড়া চত্বরটা ভরে আছে আড্ডার প্রত্যেক সদস্যের বাধ্যতামূলক ডোনেশন দেয়া মেহগনি,কড়ই, ইত্যাদি বড় বড় গাছে। গত পাঁচ বছরের গাছগুলো। চত্বরের ঠিক মাঝখানে বসার জন্য সিমেন্টের গোল বেঞ্চি, দশ/বার জন অন্তত: বসা যায়। স্থানীয় এমপি-র মাধ্যমে থানায় বলা আছে আমাদের যেন ডিস্টার্ব করা না হয়; তাছাড়া তামুক খাওয়া ছাড়া, আর কোন ধরনের ক্রাইমেও এই আড্ডার সদস্যরা নাই । অধিকাংশই সদ্য চাকরীতে ঢোকা, পরস্পরের বাল্যবন্ধু। কলোনির স্থানীয় ছেলেদের সাথে বন্ধুত্বের সূত্রে সাগর, আমি,অপু,গালিব,মতি এরা বাইরে থেকে আসা। এখানে এসে পৌঁছেছি সাড়ে সাতটার দিকে। এখানে আসার আগের ঘটনাটার ফলাফলে অপ্রতিরোধ্য ভাবে বেড়েই চলছিল বিষণ্ণতা। এক সময় তাপসকে — যার সাথে আমার সবচে বেশী জমে, যে আমার ইশারামূলক দুষ্টুমি বা ব্যঙ্গ ভরা কথা সবচে দ্রুত ধরতে পারে — পাশে পেয়ে ওর সাথে ঘটনাটা শেয়ার করতে থাকি। ঘন অন্ধকারের মধ্যে চত্বরের বেঞ্চে বসে ষ্টিক বানানোয় ব্যস্ত তাপস মনোযোগ দিয়ে প্রায় কোন কথা না বলে আমার কথা পুরাটা শোনে; শুধু ছোটখাটো দুয়েকটা প্রশ্ন করা ছাড়া।

প্রেম,বিয়ে ,এগুলো একেক ধরনের সম্পর্ক,আরো অনেক ধরনের আছে, যৌন ছাড়াও, তবু উদাহরণ হিসেবে বলতেছি– ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির কখনো এইগুলো থাকে,আবার সময়ের ব্যবধানে কখনো থাকে না । একই জেন্ডারের মধ্যেও, তুমি এমন ভাবে কথা বলতেছ যেন সময় একটা জিনিস। সময় বলতে যেন আদৌ কিছু আছে ! যেন সময় নিজেই সম্পর্ক! বরাবরে মতো তুই – তুমির বালাই না রেখে বলে তাপস, রহস্যময় ,দুর্বোধ্য হাসি হেসে।
“কিন্তু সময়ে সম্পর্ক পাল্টায় না?”
“না,পাল্টায় না, বরং মরে যায়।”
“সম্পর্ক মরে যায়! এইটা তুই কী বললি?”
“মরে যে যায়, তুই-ই তো প্রমাণ ।”
আসলে ঘটনাটার পর থেকেই আমার মনস্তাপ ক্রমে বেড়েই চলছিল। মুহুর্তের বিবেচনাহীন ইচ্ছায় বলে ফেলা কথাটাই ভাবছিলাম ।কিন্তু হৃদয় মানে না বারণ, মনের যুক্তিকে থোড়াই কেয়ার করে সে হয়ে পড়ছিল বিষণ্ণ থেকে বিষণ্ণতর; যেন তার মুখে কেউ মেখে দিয়েছে গ্লানির কালো পোঁচ। উচিত- অনুচিতের বেড়া ডিঙিয়ে সত্যের বাগানে ঢুকে আত্মা জোরালো দাবি জানাচ্ছিল ব্যক্তি-সর্বস্বতার বিচার। অবাক হয়ে তাপস ওর সব সময় আধ-বোঁজা চোখকে আরো বুজে প্রশ্ন করল, তুই সত্যি সত্যি প্রপোজ করলি?

এতক্ষণে তাপসের মত ছেলের হাসির অর্থ বুঝলাম।
“কেন করব না? আমার ইচ্ছে হতে পারে না?”
জবাব শুনে তাপস আমার মুখের উপর হেসে উঠে।

দোয়েল চত্বর থেকে শাহীন আপার কাছে বিদায় নেবার পর বিচিত্র ধরনের স্বর মিশ্রিত অনুভূতি মগজে নিয়ে সরাসরি চলে এসেছিলাম কমলাপুর এজিবি কলোনিতে আমাদের কৃঞ্চচূড়া চত্বরে। গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে জিনসের দু’পকেটে দু’হাত গুজে আজকে বিকালে যখন চারুকলার গেটের বিপরীত দিকের ফুটপাতে ধীর পায়ে হাঁটছিলাম, চারপাশটা তখন টানা দু’দিন বৃষ্টির পর এবং আজ সারাদিন বৃষ্টিহীন কড়া রোদের পর ঝকঝকে আসল সবুজে ভরা। ঢাকার অদূরে অন্য এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার স্মৃতি কম।

তিন বছর আগে ছাত্রজীবন শেষ করলেও এখনও কোন একটা নির্দিষ্ট গতি করতে না পারার অর্থহীন উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার নিয়মিত সেশন তখন আমার ধারে কাছে নাই। আমার মাথায় তখন মাত্র দুপুরে পাওয়া মুদ্রার ক্ষমতা-প্রয়োগের নকশা তৈরি হয়ে গেছে। টাকাটা পাওয়ার পর থেকেই যে ইচ্ছাটা মনের গভীরে নড়াচড়া করছিল, দৃঢ় সংকল্প হয়ে তা এখন বাস্তবায়নের পথে। এদিকে একাজে আগেও এসেছি। আজ বন্ধু বাদলকে ধন্যবাদ আসল জিনিসের খোঁজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য, অথচ হোটেলগুলোতে গিয়ে আগে ‘সুন্দর মেয়েদের’ খুঁজতাম। বিকাল ৫ টার দিকে ওরা আসতে শুরু করে । বাংলা একাডেমীর গেটের বিপরীত থেকে শুরু করে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত ফুটপাথের ও সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানের কোনার গেটটার ভেতর-বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। অবশ্য পার্কের ভেতর কিছু করি না আমি। মগবাজারের পরিচিত হোটেলে নিয়ে যাই।

এছাড়া কিছু করার নেই। স্বভাবত আলসে হওয়ায় পাশ করে বেরবার পর থেকেই বাঁধাধরা সময়ের কোন চাকরীর বদলে পত্রিকায় লাইনে ঘোরাফেরা করছি। দু’বছর ধরে কন্ট্রিবিউটর হিসেবে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করছি। আর শিক্ষানবিশ পর্যায়ে একটা পদে নিয়োগের জন্য ধর্না দিয়ে চলছি। সম্পাদকও দারুণ পিচ্ছিল, গত দেড় বছর ধরে কী দক্ষতায়ই না — সার্কাসে ছাড়া কোথাও পাওয়া যাবে না এমন নিখুঁত, ভুবন মোহিনী, পেশাদারিত্ব — ঝোলাচ্ছে আশার মূলাটা। তবে বিলটা অবশ্য খারাপ দেয় না। চূড়ান্ত আলসেমির পর মাস শেষে যে কয়টা লেখা জমে তাতে বিলটা তেমন খারাপ হয়না। মেস জীবনের রুটিন খরচের পরও ২/১ হাজার টাকা থাকে। গলা ভাসিয়ে ভেসে থাকা যায় শুধু, একজন নিম্নমধ্যবিত্ত যুবকের আবশ্যকীয় যাবতীয় ভণ্ডামির থুথু গিলে ফেলার মত সবকিছু মেনে নেওয়ার পরও।

তবে, ভেসে থাকাই সার। তীরে পৌঁছানো যায় না; বলা বাহুল্য, মহাসাগর না হোক অন্তত:সাগরের। অন্যান্য হিসেবের জন্য এমন অর্থনৈতিক ভিত্তির প্রেক্ষাপটে না পারি চাচাত বোনের সাথে শোয়ার একটা সামাজিক বন্দোবস্ত করতে, আবার টাকা না থাকার কারণে না পারি নিয়ম-কানুন মেনে দায়হীন যৌন সম্পর্কের কোন বান্ধবী গোছের যোগাতে। হাজার হাজার বছর ধরেই তো এই চলে আসছে । আমাদের মত মানুষ এত বছর ছিল বলেই এই বৃত্তিটাও এতকাল ধরে চলছে! আমি-ই প্রথম না।

একটু আগে এসে পড়লেও কোন তাড়া ছিল না বলে, চারপাশ দেখতে দেখতে — মূলত: ক্যাম্পাসের ছেলে-মেয়েদের দেখতে দেখতে– ধীরে-সুস্থে হাঁটছিলাম। টি এস সি পেরিয়ে সামনে দোয়েল চত্বর দেখা যায় এখন। প্ল্যান ছিল ওরা আসতে শুরু করার আগ পর্যন্ত এই ফুটপাত ধরেই এ মাথা-ও মাথা হাঁটব। আর বিভিন্ন সব রাজ্যের ভাবনা ভাবব। কথা বলব মনে মনে। খালি কথা, অনবরত কথা, কথার কথা, অর্থহীন কথা, যেসব কথা সারাজীবনেও পূরণ করা হবে না। এমন দৃঢ় সংকল্প, বল্গাহীন চিন্তার রাজ্যে দায়হীন সব কর্মের পরিকল্পনা, অন্ধকার মনের প্রদেশের কালো ফ্যান্টাসিতে হঠাৎ পড়া ঘোলা আলো; এইসব নিয়ে ভাবনা, কল্পনা, ফ্যান্টাসি। হাঁটছিলাম নির্মল সবুজ মানুষদের দেখতে দেখতে। দেখছিলাম শিল্পীর গভীর মনোযোগ ও মমতায় আঁকা যাত্রী ছাউনির নিচে বয়সহীন ময়লা নেশাখোরের ঝিমানি আর উচ্ছল হাসন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের যৌবনের বিকারের ডিটেলসে ভরা ক্যাম্পাস! সত্যি অদ্ভুত! মনটা বিচ্ছিন্ন আর একা আর স্বেচ্ছাচারী না হয়ে পারে না। কথাটা দুর্জনের ছলের মত শোনালেও সমাজের এই বানানো পরিবেশে না বলে পারলাম না। শেষ বিকালের আলোয় আমার ছায়া দীর্ঘ-দীর্ঘতর হতে হতে এখন রাস্তা পার হয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের লাগোয়া ফুটপাত ছোঁয়া ছোঁয়া।কখন এত দূর চলে এলাম টের পাই নি। ভাবলাম এখন ঘুরে চারুকলার দিকে রওনা দেই। আবার ভাবলাম সামনের দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরাটা যাই। একটা রাউন্ড কমপ্লিট হয় তাহলে। এইটা ভেবে রাস্তা ক্রস করে এপাশের ফুটপাথে চলে এসে আবার মোড়ের দিকে আগাতে থাকলাম। তিন-নেতার মাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বছর চারেক আগের এক স্মৃতি মনে পড়ল। চার বন্ধুকে একবার বাধ্যতামূলক রাত কাটাতে হয়েছিল মূল কবরের উঁচু বেদীতে। সে রাতের স্মৃতি রোমন্থন শুরু করতে না করতেই, ১৫/২০ গজ সামনে থামা একটা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে থাকা মেয়েটার দিকে চোখ চলে যায়। মেয়ে না বলে মহিলা বলাই ভাল, তবে বয়স ৩৫ এর বেশী হবে না, মুখের এক পাশটা দেখে তাই মনে হচ্ছে। রিকশা ভাড়া দিয়ে মেয়েটা ঘুরতেই হাত দশেক দূরে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়া আমার দিকে চেয়ে আর মুখ ফেরাতে পারে না। মুখ ফেরাতে গিয়েও কী ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার ফলে আমিও চেহারাটার দিকে ভালভাবে তাকাই। চোখাচোখি হলে, দীর্ঘ ১৪/১৫বছর গ্যাপের জন্য প্রযোজ্য সময় তাকিয়ে থাকার পর, আমি প্রথম চিনতে পারি । আর শাহীন আপা তখনো চেনা চেনা মনে হয় ভঙ্গীতে তাকিয়ে।

আমি বলে উঠি, “শাহীন আপা ! আপনে কেমন আছেন! আপনে ।আরে ! সকালে কার মুখ দেখছিলাম!” খুব একটা পাল্টায় নি শাহীন আপা। আগের চেয়ে সামান্য, খুব সামান্য মোটা হয়েছে শাহীন আপা, এ-ই যা। আগের সেই শীর্ণ আপার তুলনায় এত সামান্য যে এখনো শাহীন আপাকে চিকনই বলতে হয়। তবে আগের চেয়ে আরো সুন্দর, উজ্জ্বল, কৃষ্ণবর্ণ।

“এইটা কী অবস্থা। আপনের ! এত শুকাইছেন ক্যান?” প্রথম দেখায় শাহীন আপার চেহারার মলিনতা আমি খেয়ালই করি নাই, দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়ার ফলে। কত বছর হবে, তিরানব্বইয়ের দিকেই সম্ভবত শেষ দেখা, এরপর আমি সাভারে পড়তে চলে গেলে শ্যামলীর আড্ডাটা ভেঙে যায়। অন্তত হলের অপোজিটে মার্কেটের আড্ডাটা; আশে পাশের হোটেলগুলোতে ধুঁকতে ধুঁকতে যদিও পঁচানব্বই পর্যন্ত আমাদের আড্ডাটা ঠিকই চলেছিল।

খুশীর ঘোর আমার তখনো কাটেনি, আমি এগিয়ে গিয়ে শাহীন আপার হাত ধরি। তার আগেই অবশ্য পুরাপুরি চিনতে পেরে সে বলতে শুরু করেছে, “বান্না! স্বপ্ন দেখছি নাতো! এ-তুমি এত শুকিয়ে গেছ, তুমি? কি অবস্থা তোমার! তোমার কি হইছে! এত শুকায়া গেছ! খাওয়া-দাওয়া করোনা?”

“এই, এমনি, তেমন কোন কারণ নাই। আমি তো ছোটবেলা থেকেই চিকন।”
“তাই বইলা …”, কথা শেষ না করে শাহীন আপা কিছুক্ষণ থেমে স্বাভাবিক হয়ে বলে, “তুমি তো বাড়ায়া বললা…” থেমে কী যেন ভেবে সামান্য হেসে আবার যোগ করে, “আমি আসলে আগের মতনই আছি।একটু চর্বি জমছে খালি, কিন্তু এইটা কোন ব্যাপার না। এই হয়, এই কমে।” দম নিয়ে আবার আমার হাত ধরে বলতে শুরু করে, “চলো হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি। আচ্ছা তোমার কোন কাজ নাই তো?”
“না।”
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে আবার আমার হাত ধরে সোহরাওয়ার্দীর ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। পাশাপাশি। বিকালের যাবার সময় হয়ে গেছে। শেষ হেমন্তের সূর্যটায় আগুন লেগে গেছে। তীব্র কমলা আর তীব্র সোনালীর একটা অদ্ভুত, মায়াবী মিশ্রণ, যা চারপাশের প্রাক-সন্ধ্যার পরিবেশকে রাঙিয়ে তুলছে। মমতা আর কামনার অদ্ভুত মিশ্রণে চারপাশের ক্যারেকটারগুলো আগের মতই, তবে সংখ্যায় দশ কী বিশ, আল্লায় জানে, কতগুণ বেড়ে গেছে! বিশেষ করে বিশ থেকে তিরিশ, যদিও পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশও আছে, বছর বয়সীদের সংখ্যায় জায়গাটা ক্রমাগত ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে।

এদিকে কত যে প্রশ্ন করে চলছে শাহীন আপা। উত্তর দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম আমি। ইমরানের খবর কি? কেমন আছে ও? প্রিন্স? কী করে ও এখন? ও কিন্তু অনেক বুদ্ধিমান ছেলে ছিল। দেখ ও একদিন অনেক উপরে উঠবে। আচ্ছা রাজু কি এখনো আগের মতই? নেশা ছাড়ে নাই? ঈশ, এত ভালো ছেলেটা। বলে কল কল করতে থাকা শাহীন আপা হঠাৎ থেমে যায়। আমার অজানা কোন বিষয় ভেবে চিন্তিত, বিষণ্ণ হয়ে পড়ে সে। নেশার প্রসঙ্গ শুনে আমার মাথায় আসা প্রশ্নটা আপাতত না করে গভীর ভাবে কাছ থেকে এতক্ষণে প্রথমবারের মত শাহীন আপাকে দেখি আমি। একটু বদলায় নাই বরং আরো শীর্ণ হয়েছে। আগের চেয়ে আরো বেশী করে জেগে উঠা চিবুকের হাড় দেখে বুঝতে পারি আমি। অথচ আজকে প্রথম দেখা হওয়ার সময় কাপড় পড়ার কোনো কায়দায় শীর্ণতাটুকু ঢেকে রেখেছিল, কণ্ঠের হারমোনিয়ামের রিডের মত হাড়গুলো আর কাঁধের দুই হাড়ের মাঝের গর্তের গভীরতা দেখে আমি অনুমান করি। মাঝারী সাইজের ঝুঁটি থেকে ইচ্ছাকৃত নয়, অসতর্কতায় বেরিয়ে আসা কয়েকটা চুল ঝুলছে গালের উপর, কপালে লেপটে আছে দু একটা। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে, আবার ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে থাকে সে আমার হাত ধরে। এখন অবশ্য মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হয় না এই নৈঃশব্দ্য। অল্পক্ষণেই আবার স্বরূপে ফিরে আসে উচ্ছল, উৎফুল্ল, সদা হাস্যময়ী শাহীন আপা। জীবন যাকে নিয়ে ধোপার কাপড়ের মত আছাড়ি-পাছাড়ি করার পরও যার মুখের হাসি মিলায় না।

শ্যামলী সিনেমা হলের বিপরীতের মার্কেটে শাহীন আপার সাথে পরিচয়। সে তো প্রায় ১৬/১৭ বছর আগের কথা। আমরা সবে এস.এস.সি দিচ্ছি। প্রিন্স আমার ক্লাসমেট। প্রিন্সের বন্ধু ইমরান আগারগাঁও থেকে আসত। অপু শ্যামলীর ১ নম্বর রোড থেকে। প্রিন্সের বাসায় আড্ডা দিতাম আমরা। তবে তা সামান্য। খিলজি রোড থেকে নোমান, সুদূর টিপু সুলতান রোড থেকে উজ্জ্বল, অপুর বান্ধবী সুরভী (সে তখন ৮ বছর কানাডায় থেকে সবে দেশে ফিরেছে) এছাড়া নিয়মিত-অনিয়মিত আরো কয়েকজন আসত সে আড্ডায়। লাগাতার আড্ডা ছিল সেগুলো। মার্কেটটা তখন অর্ধ-সমাপ্ত। নিচতলায় বাইরে এক কোণে ছিল জাপান কালার ল্যাব, আরেক কোণে লিটন ভাইয়ের বই-বিচিত্রা। এছাড়া মাঝখানে আকিব ভাইয়ের জেনারেল ষ্টোর আর একটা কনফেকশনারি। অফিসের পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, তখনো ব্যাংকটা হয়নি। শুধু সামনের রাস্তার দিকে এক কোণে বই বিচিত্রার উপর রেইনবো ম্যাসেজ পার্লার। আজকাল ঢাকায় ম্যাসেজ পার্লার বেশ কমে গেছে, প্রায় চোখেই পড়ে না। তখন একটা হুজুগ ছিল মোড়ে মোড়ে ম্যাসেজ পার্লারের। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কিছু বলত না। বেশ্যা-পাড়ার এক ধরনের বিকল্প ছিল এই ম্যাসেজ পার্লারগুলো। পার্লারের ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই সামনে পড়ে টেবিলের উপর পত্র-পত্রিকা-ওলা ওয়েটিং রুম। রুমের ওপাশে থাকত চিকন প্যাসেজের দু’পাশে থোকা-থোকা ছোট ছোট রুম। ম্যাসেজ করানোর উপযোগী ফোম অলা ইজি চেয়ারে জামা-প্যান্টের জিপার খুলে ঢিলে ঢালা হয়ে বসা কাস্টমারের পাশে দাঁড়িয়ে কোন একজন কর্মচারী মেয়ে তাকে ম্যাসেজসহ হস্তমৈথুন করে দিত, এই হলো ম্যাসেজ। পেশাগত দায়িত্ব কালীন মুহূর্তে প্রাকৃতিক কারণেই মেয়ে কর্মচারীদের নানারকম পেশাগত হ্যজার্ডের মুখোমুখি হতে হতো। ঠোঁটে দগদগে লাল দাগ নিয়ে, বা স্তনে কালশিটে নিয়ে ঘরে ফেরা পেশাগত দায়িত্বের অংশ না হলেও বাস্তবতা বা দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে তাদের তা মেনে নিতে হত।

তো শাহীন আপা কাজ করতো এই রেইনবো ম্যাসেজ পার্লারে। নেশাখোর স্বামী আর দুই-সন্তানের সংসারের বোঝা টানার জন্য ।মার্কেটের ভেতরে দোকান পাট তখন কিছুই হয়নি। তিন আর চার তলায় গার্মেন্টস হলেও একতলা ও দোতলায় কাজ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ ছিল । কাজের জন্য ইটগুলো স্তূপীকৃত ভাবে সাজানো ছিল পিছনের দেয়ালের সাথে, কতকগুলো বাঁশ পড়ে ছিল মার্কেটের পিছনে, ১৫ বছর আগে মোটামুটি দেড়শ থেকে দুইশ বর্গগজের একটা উঠান। উঠানের এককোণে মেয়েদের টয়লেট। ডান কোণায় আমরা ছেলেরা আড্ডা দিতাম বাঁশগুলোর উপর বসে। আড্ডার মহিলা সদস্য সুরভিও ময়লা জিনস পড়ে নির্দ্বিধায় আমাদের পাশে বসে সিগারেট খেতে খেতে আড্ডা দিত। আবার দুয়েক সময় স্টিক চললে তাও খেত। চলতি ফ্যাশনের না, ও ছিল সত্যিকারের সুন্দর, কোমল মনের ডেসপারেট একটা মেয়ে। যে কিনা, আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করতাম ভণ্ডামি জানত না।

লিটন ভাইও আমাদের আড্ডার একজন নিয়মিত সদস্য ছিল। আমাদের দশ-বার বছরের বড় হলেও অসম্ভব মুখ খারাপ করত সে। তো, আমাদের পাশ দিয়েই পার্লারের অন্যান্য মেয়ের মত টয়লেটে যেতে হলে শাহীন আপা লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখত। আমার বলতে ইচ্ছা হত, এতে তো লজ্জার কিছু নাই। সব বান্দা পায়খানা করে! কিন্তু আরো বেশী লজ্জা পাবে বলে বলতাম না। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পার্লারের মেয়েরা কখনো আমাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করত না। কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে পার হয়ে যেত জায়গাটুকু শাহীন আপা। আমরা ভদ্রতা বশত মাথা নিচু করে রাখতাম, বা ঘুরিয়ে রাখতাম। কেমন যেন খারাপ লাগত, আসলে সবাই সবকিছু জানে। কিন্তু একদিন শাহীন আপা টয়লেট থেকে ফেরার পথে আমি তার দিকে চেয়েছিলাম। আট-দশ সেকেন্ড লাগে আমাদের পার হয়ে যেতে। প্রথমে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলেও এই অল্প সময়ের মধ্যে আরো দুবার আমার দিকে তাকায় সে, এবং দ্বিতীয় বার চোখ নামায় না, কাছে এসে বলে, “কেমন আছেন?” আমি এতটা কেন, কিছুই আশা করি নাই। তাই প্রথমে হতবাক হয়ে জবাব দিতে একটু দেরী হয়ে যায়।
“ভাল। আপনে ? ভাল আছেন ?”
“এই আর কি! চলছে! আমাদের আবার থাকা!”
দীর্ঘশ্বাস না ছেড়ে হাসি মুখে বলে শাহীন আপা। কোনো কষ্টের ছাপ ছাড়াই।
“না, তা হবে কেন পরিশ্রম করে…”
আমাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে সুরভি বলে, “বসেন না। আমাদের সাথে একটু গল্প করেন। প্রতিদিন দেখা হয় । আফটার অল, আমরা তো একরকম দিনের অর্ধেক সময় একই বিল্ডিংয়ে থাকি। বসেন না একটু, অবশ্য আপনার যদি কাজের চাপ না থাকে ।”
“না কাজের চাপ নাই। দুইটার সময় কে আসবে? এখন তো বউয়ের সাথে থাকার সময়”, বলতে বলতে সুরভীর পাশে একটু দূরত্ব রেখে বসে। সুরভি আমাকে দুষ্টামির ইশারা করলে আমি গিয়ে মাঝখানের যথেষ্ট খালি জায়গায় বসি। অবশ্য দু’পাশে কারো গায়ে গা না লাগিয়ে।
“দেখছেন!” শাহীন আপার দিকে ফিরে সুরভী বলে, “কত জায়গা ছিল, আরো একজন বসা গেল।”

আড্ডায় উপস্থিত সবার সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আমি। সেও তার নাম বলে আমার নাম শাহীন। লিটন ভাই ছিল না ঐদিন আড্ডায়। বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তায় পর শাহীন আপা জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা লিটন ভাই আসেনাই?”
“লিটন ভাইকে আপনি চিনেন কিভাবে?” অপু বলে।
“বাহ! তোমরা জান না? লিটন আমার কাস্টমার না!” যেন একজন মুদি দোকানী বলছে ঠিক সেরকম সুর তার কণ্ঠে। “ও তো প্রায়ই যায়। কী শয়তান দেখছ? তোমাদের বলেনি। দাঁড়াও আসুক আজকে।”

আসলে আমি জানতাম, আমাকে একদিন নিয়ে গিয়েছিল। আমি ওয়েটিং রুমে বসে বসে একটা ভারতীয় ম্যাগাজিনে ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে সুপ্রিয়ার সাক্ষাৎকার পড়লাম। জমজমাট। দেখলাম দশ মিনিটে হয়ে গেল লিটন ভাইয়ের। সেদিন শাহীন আপাকে দেখি নাই ।অবশ্য মেয়েগুলোকে ওয়েটিং রুম থেকে দেখা যায় না।

তবু এই মুহূর্তে কিছু না বলে চুপচাপ থাকি আমি। এই থেকে শুরু। এরপরে টয়লেটে যাওয়া আসার সময় আমাদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়া নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তার। অনেক সময় ম্যানেজারকে এসে ডেকে নিয়ে যেত হত। সরল,অকপট শাহীন আপার কাছ থেকে তার পারিবারিক জীবন-বৃত্তান্ত জানা গেল। গতানুগতিক গল্প। নেশাখোর স্বামীর জন্য দৈনিক দুইশ টাকা বরাদ্দ ছাড়া ২ আর ৩ বছরের দুই সন্তানের লালন-পালনসহ পুরা সংসারের খরচ উঠাতে হত তাকে। প্রেম করে বিয়ে করেছিল। কিশোরী চিত্তের অনভিজ্ঞ স্বপ্নের উপর ভর করে আশা করেছিল ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দশ বছর পর এখনো ঠিক হয়নি। প্রেমের ভস্মস্তূপ আর বাকি নাই। আবার ভাবি, সত্যিই কি নাই? একদিন আমার ‘লাথি মাইরা ছাইড়া আসেন না ক্যান’ প্রশ্নের জবাবে বিস্ময়ে, বিমূঢ় হয়ে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। চোখের পানি চলে এসেছিলে শাহীন আপার। শাহীন আপা আমাদের আড্ডার সদস্য হওয়ার চার/পাঁচ দিনের মাথায় সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছিল যে, শাহীন আপা লিটন ভাইয়ের প্রেমে পড়েছে। আর লিটন ভাই প্রেমের ভান করছে। আমি বুঝি না শাহীন আপা কিভাবে আশা করল যে তার মত সামাজিক অবস্থানের একটা মেয়েকে পাঁচতলা বাড়ির মালিকের দুই ছেলের একজন, যে কিনা ভাল ইনকামের একটা দোকানের পজেশন সহ মালিক, তাকে বিয়ে করবে। মেয়ে মানুষের অনুমান নাকি নির্ভরযোগ্য -এই কি তার নমুনা! মাঝেই মাঝেই দেখতাম স্কুটারে করে শাহীন আপা লিটন ভাইয়ের সাথে কোথায় যাচ্ছে। একদিন আমি আলাদা জিজ্ঞেস করলে বলল লিটনের বন্ধুর এক ফ্ল্যাটে যায়।

“আপনি এটা কী ভুল করতাছেন? আপনি লিটন ভাইরে চিনেন না?” মাথা নিচু করে জবাব-হীন অনড় দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর যখন মুখ তোলে ছলছল চোখ নিয়ে বলে, “রাতে বাসায় ফির‌্যা দেখি মাল খাইতেছে, সকালে ভাত রাইন্দা আসছি, খায় নাই।” এখানে শাহীন আপার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে, একটু থেমে চোখের পানি মুছে, “চোখ বন্ধ করে ঝিমায়। একসাথে খাইতে বললে পর বলে, পরে খাবে। খায় সেই রাইত তিনটা চারটায়। সকালে উইঠা যখন রান্দা-বান্দা, গোসল করি, রওনা দেই তখন সে অঘোর ঘুমে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। সকালে বালিশের নিচে দুইশ টাকা রাখা ছাড়া আর কোন সম্পর্ক নাই।”

“কিন্তু আপনে তো তারে আর ছাড়তে পারবেন না।” — আমার এ কথায় মন খারাপ করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে প্রসঙ্গ এড়িয়ে আবার শুরু করে, “আমিও তো মানুষ, বান্না, শরীরের কথা নাইলে বাদ-ই দিলাম।”

“এইটা হইলে কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আপনি তো লিটন ভাইয়ের প্রেমে পড়তাছেন? কী সাংঘাতিক অবস্থার দিকে যাইতাছেন আপনে বোঝেন না।” পর-পর দুবার চোখের পলক ফেলে শাহীন আপা। কথা শুরু করতে গিয়েও পারে না। গলা আটকে আসে তারপর কথা বলার চেষ্টা ত্যাগ করে গভীর যন্ত্রণা মাখা হৃদয়ে নিথর হয়ে বসে থাকে ও কিছুক্ষণ পর সর-সর করে কেঁদে ফেলে বলে, “বান্না আমি কী করব ? তুমি যা বলবা। তা-ই করব ! বান্না তুমি জান তুমি আমার কাছে কী ! তুমি বল আমি এখন কী করব।”
“শোনেন লিটন ভাইয়ের সঙ্গে বাইরে যাওয়া আপনার ছাড়তে হবে। ওর কাজও করবেন না। অন্য মেয়েদের দিয়ে করাবেন মোট কথা লিটনের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবেন না।”
“এইটা সম্ভব না। বান্না দেখ লিটন যেইসব ভাব দেখায়, বাড়ির অর্ধেক, গাড়ি এসব ভুয়া আমি জানি। এইসব আমি এক কান দিয়া ঢুকাইয়া আরেক কান দিয়া বের করে দেই। অনেক সময় ঢুকাইও না। কিন্তু সেটা কথা না। আমি যে ওকে ভালবাসি, আমি লিটনকে ভালবাসি এইটা সেও বোঝে, আর আমাকে ব্যবহার করে, তবু সেইটাই যে কী মধুর! যদি সারা জীবন আমাকে ব্যবহারই শুধু করে তাহলেও আমি ধন্য। বান্না আমি এখন কী করব বান্না ? বিয়ার পর থেকে এমন রাত নাই যে রাতে আমি কাঁদি নাই। রাতের পর রাত কাঁদি। সবাই আমার হাসি শুধু দেখে, আমার কান্না কেউ দেখে না। ওকে যে আমি ভালবাসি।” — হু-হু করে কাঁদতে কাঁদতে বলে শাহীন আপা।

“তাহলে আপনের কপালে আরো খারাপি আছে। কাইন্দেন না। চোখ মুছেন। মুখ ধুইয়া আসেন। ওরা আসতে পারে।” আরো ৪/৫ ঘণ্টা কথা বলেও শেষ হবে না বুঝতে পেরে আলাপ শেষ করি।
“আগে একটা ছিল, এখন দুইটা হইছে। কী করব বান্না, এখন আমি? ওকে দেখলে সব ভুলে যাই। কিছু মনে থাকে না। বিশ্বাস কর বান্না, পৃথিবীতে নিজের চেয়ে সুখী আর কাউকে মনে হয় না। তুমি হাসতেছ! শোনো লিটনের মনের খবর আমি জানি, কিন্তু তাতে কী ? ও যে দুই এক ঘণ্টার পর থাকবে না আমার পাশে তা আমি জানি। তবু যতক্ষণ থাকে পাশে…” — প্রেমের স্বীকৃতির বাসনায় প্রশ্নাতুর চোখে চেয়ে থাকে শাহীন আপা। নত মুখ, চিন্তিত, বিষণ্ণ।

শাহীন আপাকে দেখতে দেখতে মুহূর্তে পার দিতে থাকা ছুরির মত দ্রুততায় শ্যামলীর আড্ডার দিনগুলো মানস পটে ভেসে উঠল। এরপরে ঘটনা আমার ধারণা মাফিকই হয়েছিল। মাস দুয়েকের মাথায় শাহীন আপা তাৎক্ষণিক নোটিশে ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার একদিন আগে বানানে ঝগড়ায় লিটন ভাই শাহীন আপার সাথে তার সম্পর্কের সমাপ্তি টানে। কিন্তু বেশিক্ষণ বিষণ্ণ থাকে না। শাহীন আপা, কি যেন কী স্মৃতিচারণ করে মাথা উঁচিয়ে হেসে আমাকে হাত টানতে টানতে বলে, “চল,চল রোড ক্রস করতে হবে।” একটু থেমে যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে, “চল ঐ পাশের চায়ের দোকানটায় বসি। ঐখানে ভিড় কম। আমরা একপাশে বেঞ্চে গিয়ে বসতে পারব।”

‘ভিড় কম’ এটাই কি পরিবর্তনটা এনেছিল? যদিও শাহীন আপার কণ্ঠে এক ফোঁটা ইঙ্গিতও ছিল না। সে যাই হোক, এরপর পরবর্তী যে ৪৫মিনিট আমি তার সাথে কাটাই তার পুরা সময় জুড়ে আমার মাথায় ‘ভিড় কম’ এর অনুরণন চলছিল। ঝর্ণার মত উচ্ছল কলকল করে কথা বলেই চলছিল শাহীন আপা, কত যে প্রশ্ন তার, আবার কত যে গল্প তার নিজের, ঘোলা বাল্বের আলোয় ভ্যানগাড়ির চায়ের দোকানের একপাশে রাখা একটি মাত্র বেঞ্চে বসে শুনি আমি। চাকার চারপাশ ছিল আধা ঘোলা আলো, আধা অন্ধকারে ঢাকা। ফলে পরস্পরের চেহারা পুরাপুরি স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম না। আর সেও কথা বলছিল দোকানের আধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে, অবিরল কথা। আমার অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করার আর টাইম ছিল না তার। এদিকে মনের ভেতর কামনা জেগে উঠছিল আমার। যতই আড়চোখে শাহীন আপার দিকে তাকাচ্ছিলাম ততই ইচ্ছা আমাকে দখল করে বসছিল। আমি ভাবলাম, কেন অসুবিধা কি? সেই কবে ১৫/১৬ বছর আগে শেষ দেখা। হঠাৎ অনেকক্ষণ ধরে মাথায় ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা করে ফেলি, “এখানে কোথাও আসছেন নাকি?”

প্রশ্নটা অপ্রীতিকর বলে, আবার উওর-টাও জানা বলে এতক্ষণ করি নাই। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া, জবাব, জবাবের ধরণ, ভঙ্গি সবকিছু আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমি শাহীন আপাকে ভুলে গেছি। আমার মনে পড়ে এই মহিলাই শ্যামলীতে ইমরানের দুষ্টামি মাখা ‘আচ্ছা আপনারা কী করেন মানে, আপনাদের কাজটা কী।’ প্রশ্নের জবাবে খিল খিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে শাহীন আপা বলেছিল, ‘বিশ-ত্রিশ জন…’, বলে আবার হাসতে থাকে। ইমরান আবার ‘মানে’ জিজ্ঞেস করলে, ‘খবরদার আর একটা কথা বলবা না’ বলে চাটি মারে ইমরানের মাথায়, হাসি তখনো থামে না।

আমার প্রশ্নটা শুনে মাত্র দুই-এক সেকেন্ড চুপ থেকে একবার আমার দিকে, তারপর আবার চাকার দিকে ফিরে, শান্ত, ধীর কণ্ঠে বলে, “বান্না, কত কিছু হইয়া গেল এর মধ্যে। কতদিন পর দেখা, তুমি তো অনেক কিছু জান না, আমি এখন আধা না, পুরা বেশ্যা। এদিকেই কাজ করি, অবশ্য বাগানে না। আমি এখান থেইকা কাস্টমার নিয়া নবাবপুরে পরিচিত হোটেল আছে, সেইখানে চলে যাই।”
“আপনার হাজব্যান্ডের খবর কি?”
“আছে!” দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বলে।
“সেই বাচ্চা দুইটা ছেলে না মেয়ে যেন?”
“দুইটা মেয়ে, ওরা ভালোই আছে।” বলে আমার দিকে ফিরে হেসে বলে, “আমাদের আবার থাকা। এইসব বাদ দাও, তোমার খবর বল। তোমার অবস্থা কী?”

আমি সংক্ষেপে আমার বৃত্তান্ত জানাই যান্ত্রিক ভাবে, কেননা মাথার ভেতরে তখন গুঞ্জন করছিল অসংখ্য মৌমাছি। রাণী মৌমাছির চেন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে সামলানোর অযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আমি বলি, “শাহীন আপা, কিছু মনে কইরেন না, আপনে আমার সাথে যাবেন?”
“কোথায়?” বলেই আমার কথার অর্থ বুঝতে পেরে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। বিমূঢ় মন নিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “বাইরে না হলেও ভেতরে ভেতরে এত বড় হয়ে গেছ? বান্না ,তুমি জানো না আমার কাছে কী এখনো। হ্যাঁ, এখনো। গত ১৫/১৬ বছর তোমাকে আমার প্রায়ই মনে পড়ত। এতক্ষণ লজ্জায় বলি নাই, যদি তুমি ভুল বুঝ। এখন বললাম। কেন বললাম?”

এরপর যে অস্বস্তি নেমে আসে তাতে বেশিক্ষণ কথা চালানো যায় না। আমি উঠেই বিল দিতে গেলে শাহীন আপা আমাকে জোর করে থামিয়ে নিজে বিল দেয়, কোন কথা বলে না। আমার তখন খারাপ লাগতে শুরু করেছে। ‘বলব না বলব না করেও কেন যে বলতে গেলাম?’ আমার মনের একটা অংশ তখনো যুক্তির পর যুক্তি তৈরি করে চলেছে আমার বলে ফেলার ইচ্ছার সমর্থনে। দোয়েল চত্বর পর্যন্ত আমাকে আগিয়ে দেয় শাহীন আপা। এ সময় দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। এক সময় শাহীন আপা আমার হাতটা আবার ধরে, চাপ দেয়, যেন বলতে চায়, ‘এটা কোনো ব্যাপার না, হতেই পারে। মন খারাপ করো না, প্লিজ!’ এজিবি কলোনিতে রিকশা ঠিক করে ওঠার সময় তখনো সে আমার হাত ছাড়ে নাই। আমি বলি , “শাহীন আপা,সরি।” আবার সেই আগের পুরান বাঁধভাঙা হাসি। আমার মনে পড়ে, “তোমরা শুধু আমার হাসিই দেখ,আমার কান্না কেউ দেখ না।”

Loading

10 Comments

  1. অসাধারণ

  2. চমৎকার

  3. খুব ভালো লাগলো

  4. অভিনন্দন

  5. ভালবাসা এমনই হয়– –। তবুও চলুক অবিরাম ।

  6. অর্থহীন ঘোরাঘুরি — বেশ ভালো।

  7. ভাল লাগল।

  8. অসাধারণ প্রকাশ।

  9. বেশ ভালো লাগলো।।।

  10. দারুন লিখেছেন

Leave a Reply

Skip to toolbar