
সৌন্দর্যের ডাহুক ডাক
সুবিমল মিশ্র—লেখা প্রকাশ বিষয়ে
হৃদরোগে ও বয়সজনিত অসুস্থতায় সুবিমল মিশ্র মারা গেলেন ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ ভোর ৪টা ৫০-এ।
জন্ম হয়েছিল ২০ জুন, ১৯৪৩। তখন ব্রিটিশ ভারত। দেশ ভাগ বা নতুন দেশের জন্মের সময় তাঁর বয়স ছিল চার বছর মাত্র। বলা যায় একটা নতুন দেশের প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন, সেই দেশটা তাঁকে সারাটা জীবন একটা অসুখী, ক্রুদ্ধ ও হতোদ্যম, রাগী ও হতাশ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। থেকে গেলেন সুখভোগের দূরে, নিজের রচিত ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’। তিনি ছিলেন এক বিরল বৃক্ষ যার ডাল-পালা-শিকড়-ফল-ফুল থেকে আর তেমন কোন নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয় নাই। তিনি ছিলেন নিজের মত, অ-অনুসরণীয়!
অথচ সুবিমল মিশ্র ছিলেন আশি ও নব্বই দশকে পশ্চিম বাংলার তরুণ সাহিত্য কর্মীদের আরাধ্য, বাংলাদেশের তরুণদের কাছে দূর থেকে দেখা নক্ষত্রের আলো। কিছু লিটল ম্যাগাজিনের কাছে তাঁকে নিয়ে ছিল উন্মাদের ভালবাসা, তীব্র আবেগ। তাঁকে নিয়ে কিছু রচনা করতে গিয়ে প্রায় সব লেখকই হয়ে যেত হতবিহ্বল। তাঁকে বর্ণনা করতে গিয়ে সবাই তাঁর উদ্ভাবিত জটিল বাক্য-বিন্যাসে সাঁতরাতে থাকতো।
সুবিমল মিশ্র নিজের ছোটগল্পগুলোকে অ্যান্টি-গল্প এবং উপন্যাসকে অ্যান্টি উপন্যাস বলতেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে এন্টিউপন্যাস লিখে সাহিত্যে ‘এন্টি’ ধারণাকে উপস্থাপিত করেন। কিন্তু আসলে তা ছিল তাঁর নিজেরই উদ্ভাবিত একটা প্রকার। কি আছে সে প্রকারে? আজ ২০২৩ সালে বসে তা সহজেই কাঁটাছেঁড়া করা যায়, তবে সেই সময়কালে তা ছিল অভূতপূর্ব এক অসম্ভব প্রয়াসের ফল। লেখক সামাজিক বিচ্যুতি, অসমতা আর হৃদয়হীনতায় ক্ষুদ্ধ হয়ে লিখলেন এমন এক ভাষায় যা নিজেই বিচ্যুত, অসম আর হৃদয়হীন। তবে তাঁর প্রথম দিককার ছোটগল্পগুলি নিজস্ব এক আলাদা রূপক ঢংয়ে কঠিন রিয়ালিষ্ট ধরণের, পাঠক সেখানে সহজাত কল্পনা পায়, লেখা পড়ে আনন্দ পায়। একটা নমুনা:
তারপর মেয়েটা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে দেখন-চাচা এক কাণ্ড করে বসলেন।
মেয়েটার কাছে গিয়ে বললেন: তোমাকে আমি ইচ্ছা করি।
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল: কি?
দেখন-চাচা বললেন: রতি যাঞ্চা চাহি।
মেয়েটা লজ্জায় মরে গেল।
দেখন-চাচা বললেন:
উপকার করি’ যদি দাম নাহি চায়,
হয় মিথ্যা কথা বলে না হয় ভাঁড়ায়।
মেয়েটা কি করবে বুঝে উঠতে পারল না।
দেখন-চাচা সযত্নে তার হাত ধরলেন, বললেন:
জননী জায়ার মাঝে ভেদাভেদ নাই,
একজন স্তন্যদাত্রী অন্য জন মাই।
বলে, অত্যন্ত সহজ-ভঙ্গিতে তার বুকের কাপড় খসিয়ে নিলেন।
(বাগানে ঘোড়ানিমের গাছে দেখন-চাচা থাকতেন)
প্রথম থেকেই তাঁর লেখা লেখকের নিজের পছন্দ আর যুক্তি বহন করতে থাকে। লেখাগুলির ভিতর একপ্রকার আরাম থাকে। ১৯৬৯ সালটাকে বলা যায় তাঁর লেখার জন্মলগ্ন!
সুবিমল যতই এন্টি গল্প বলেন না কেন, তা আসলে একপ্রকার মূল ধারাই গল্প। আসলে এন্টি বলতে প্রথমে যা বলতে চান, একসময় তা মূল ধারাই হয়ে যায়। একটা ধরণ লক্ষ্য করা যায় যে, প্রথমে সুবিমল বর্ণনা বলতেন ‘হল, করল, গেল’ ফর্মে, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর বাক-ভঙ্গী বদলাইয়া গেল। তিনি বলতে থাকলেন ‘হয়, করে, বলে’। যেন তার বলার কথাগুলি অনেকদিন ধরে চলে আসছে।
‘লোকদুটো তখন গলা খাঁকারি দেবে, প্রস্তুত হবে। বলবে: টাকা চাও? মেয়েটি যন্ত্রচালিতের মত ঘাড় নাড়বে। লোকদুটো বলবে: সাদা গাধাটার মাংস খেয়েছিস তো ঠোটে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে মুছে ফ্যাল। এই বলে একজন নিজের পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করে তার মুখ মুছিয়ে দেবে। মেয়েটি শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকলে লোকদুটো একটু কেশে চোখ পিটপিট করতে করতে বলবে: টাকার গাছ এক পবিত্র সম্পদ। তাকে যখন তখন যেভাবে সেভাবে ছোঁয়া যায় না। সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে ছুঁতে হয়। তুই তোর শাড়ি খুলে ফ্যাল। মেয়েটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে, ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে পারবে না। সেই সময় লোকদুটো নিজেদের পোশাক খুলে ফেলতে থাকবে,বলবে:এই দ্যাখ আমরাও খুলে ফেলেছি।’
(ময়দানে টাকার গাছ)
কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে উদ্দেশ্যমূলক গল্প লেখার দিকে চলে যান।
‘দাদ-এগজিমা সারিয়ে নিন চুলকানি সব সারিয়ে নিন রোগজীবাণু সারিয়ে নিন ফুলের সুরভি শ্বাসে-প্রশ্বাসে মধুর পুলক ভেসে ভেসে আসে নাচুন নাচুন ধেই ধেই নাচুন ফিরিয়ে আনুন ত্বকের স্বাস্থ্য ট্যাঁকের স্বাস্থ্য যেটুকু না হলে নয় সেইটুকুতেই কেনাকাটা সমঝে রাখুন দেখবেন দর বাড়বে না অসাধু ব্যবসায়ীরে পরাস্ত করুন কেমনে করবেন হে ক্রেতা ক্রেতা হে প্রসেস লউন দর বাড়িলে আতংকিত হইবা কাহিকে বেশি কিনে ফেলবেন না ফেললে পরে নির্ঘাত আপনে জিনিসের দর বাড়িয়ে দিলেন ছোট পরিবারই সুখী পরিবার যদি চান পাঁচন খান চোঁয়া ঢেঁকুর সেরে যাবে গজগজানি সেরে যাবে বিপ্লবিআনা সেরে যাবে ভালো ভালো হাগা হবে যদি চান পাঁচন খান যেমনি সরেস তেমনি গাঢ় তেমনি কড়া কেশ নড়ে না বাল পড়ে না টাকের ভেতর নৌতুন নৌতুন চুল গজায় অর্শের জ্বালা দূর করে পেটের জ্বালা দূর করে জ্বালা
দূর করে দাদ-ও-এগজিমা সারিয়ে নিন চুলকানি সব সারিয়ে নিন রোগজীবাণু সারিয়ে নিন ফুলের সুরভি শ্বাসে-প্রশ্বাস মধুর পুলক ভেসে ভেসে আসে নাচুন নাচুন ধেই ধেই নাচুন নাচুন আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর কোল্ড-ক্রিম তখন আপনার ত্বকের’
(আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর/কোল্ড-ক্রিম তখন আপনার ত্বকের গভীরে কাজ করে)
সর্বশেষ উদ্ধৃতি থেকে বুঝা যায়, গল্পে টেক্সটের মাধুর্য বদলায়ে সুবিমল তাঁর ব্যক্তিক ক্ষোভ প্রকাশকেই প্রধান করে তুলেছেন। এইভাবে সুবিমল ক্রমশ ‘পাইপ গানের’ মত গরম হয়ে উঠতে থাকেন। তাঁর ভাষা ক্রমেই ব্যক্তিগত হয়ে উঠতে থাকে। তাতে জড়িয়ে পড়তে থাকে আরো রাগ, আরো উৎকণ্ঠা, আরো বিতৃষ্ণা।
সুবিমল মিশ্র হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদী সাহিত্যের প্রতীক হয়ে। নিজেকে সারাজীবন ভেঙেচুরে আলাদা করে বিনির্মাণ করেছেন। ক্রমশ: পাঠকদের জটিল পরীক্ষায় নিপতিত করেছেন। তরুণ গল্প লেখকদের নানান ফাঁদে ফেলেছেন। তিনি হয়তো জানতেন, তাঁর মত আর কেউ হতে পারবে না। যে পথে তিনি গেছেন সেই পথ ধরে একবারই যাওয়া যায়। তা ব্যাখ্যা করেও ধরা যায় না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হয় সেই সৃষ্টি!
লেখা প্রকাশ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত ছিল। তা হয়তো ঠিক, আবার কখনও ঠিক নয়। সবকিছুই নানান প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে। সব কিছুই অনেক কিছুর সাথে সাপেক্ষ! কোন ফর্মুলাই খাটানো যায় না। সারা জীবন শুধু বিকল্প প্রকাশ মাধ্যমে লেখা প্রকাশ করতে থাকা খুব একটা বাস্তব সম্মত নয়। কারণ পাইপ গান দিয়ে সব যুদ্ধ করা যায় না, সোশাল মিডিয়াও কখনো কখনো অধিক অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
কবি মোহাম্মদ রফিক গতকাল মারা গেলেন
একথা বলাই যায়, প্রমিত ভাষায় অপ্রমিত বিষয় নিয়া লেখা ব্যাপারটা তাঁর কবিতাকে ব্যাহত করেছে। তাঁর মূল স্বভাব ছিল বাউলানা, রোমান্টিক! কবিতা লিখেছেন তার উল্টাটা! চিন্তা করেছেন কৃষককে নিয়া, কিন্তু তাদের ক্ষেত মজুর হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
মারা গেলেন বৃষ্টিভরা দিনে। কবরে মাটি গলে গলে যাচ্ছিল। পরের সকালে দেখা গেল পাখিরা উড়ছে। পাখি নয় কাকেরা এলোমেলো ভাবে অজানা উত্তেজনায় দালানের ফাঁক দিয়ে গোত্তা খেয়ে যাচ্ছে। মনে হল যেন কবি রফিক ভেজিটেবল স্বৈরাচার এরশাদকে নিয়ে তীব্র ‘শালা’ কবিতা লিখে ছটফট করেছে সারা জীবনের মত একটা পরিচয়ে আটকে গিয়ে। তাঁর মত কবির এমন হবার কথা না।
১৯৮১ সালে ময়মনসিংহে গেছিলেন কবিতা পড়তে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিন্তু আমাদের মত তরুণদের সাথে মদ খেতে রাজি হলেন। তাঁর থাকার জায়গা হয়েছিল কৃষি ইউনির বর্তমান ভিসির বাসা তখন গেস্ট হাউস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, সেখানে। শহর থেকে কবি নাজমুল জেরিক্যান ভরে সুইপার কলোনি থেকে চোলাই মদ নিয়ে আসলেন। উনি তরুণ কবিদের সাথে মদ্যপানের চ্যালেঞ্জ দিলেন।
আমারই ক্যাম্পাস। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। নিজের ক্যাম্পাসে নিজের ভিসির বাসায় বসে আরেক ইউনির শিক্ষকের সাথে মদ পানের কথা আগে কখনো ভাবি নাই। তারপর আবার চ্যালেঞ্জ! বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। সেদিন আবার গেস্ট হাউসে তেমন কেউ নাই। ফলে হৈচৈ করা যাচ্ছিল।
আমি তখন বেশ তর্কপ্রবণ ছিলাম। সাহিত্য বিষয়ে নানান রকম মতামত নিয়ে পরীক্ষারত। নিজের ভাষা খুঁজছি বিজ্ঞান, প্রকৌশল আর নৈর্ব্যক্তিক ইমেজারিতে। রফিক ভাইয়ের সাথে তর্ক লেগে গেল। আমরা ধাঙড়দের বানানো বদ গন্ধযুক্ত পানীয় খাচ্ছিলাম আর উত্তেজিত হয়ে উঠছিলাম। মোহাম্মদ রফিকের সাথে নাজমুল খুব তাল দিয়ে যাচ্ছিল মার্কস বাদ, লেনিন, শ্রেণী সংগ্রাম এসব কবিতায় প্রয়োগ নিয়ে। কিন্তু ওরা কবিতা থেকে ক্রমেই সরে গিয়ে এসব তত্ত্বের প্রয়াগ কিভাবে করা যায় তাতে চলে যাচ্ছিল। পরে জেনেছিলাম দুজনের চিন্তাই তখন সিপিবি লাইনে ছিল। রফিক ভাই কয়েক বছরের মধ্যে ক্ষেতমজুর সমিতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।
রফিক ভাই চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন বটে কিন্তু দেখলাম প্রথমে যে মগ ভরে বসেছিলেন তা আর খালি হয় নাই। অর্থাৎ উনি সারারাত ধরে পানের অভিনয় করে গেছেন। কয়েকটা চুমুক দিয়েছেন মাত্র! অর্থাৎ উনি আমাদেরকে নিয়ে খেলতে চেয়েছেন!
ওনার এই চালাকি দেখে খুব খারাপ লাগল আমার। সিনিয়র মানুষ কিছু বলাও গেল না। আর আমিও ঐ পানসে মদে তেমন কোন টক্সিক হচ্ছিলাম না। তাই ভোর না হলেও রাগ করে তাঁকে পরিত্যাগ করার মনস্থ করি। গেস্ট হাউস থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তখনো গেট খোলে নাই। ল্যাগব্যাগ করে দেয়াল টপকাইয়া বের হয়া আসলাম। তারপর সোজা আমার শামসুল হক হলে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লাম।
রফিক ভাই বিখ্যাত হলেন ছদ্ম ফ্যাসিস্ট এরশাদকে নিয়ে কবিতা লিখে, কিন্তু ঐ-টা ছাড়া কী চমৎকার কবিতাই না উনি লিখেছিলেন:
হা উন্মাতাল/ভস্মের হাসি,/হাওয়ায় আকুল;
আমি খুঁজি,/দুধে-নাওয়া/ চাঁপার পাপড়ি;
হু হতশ্বাস/ছলছলাৎ জল/জোয়ার-ভাটায়,/শব-পচা ঘ্রাণ;
জল বলে, চ চল/সাগর উথাল;
আমি গনি,/ধূপ-চামেলির/অথই কৌতুক!
বা
ফড়িং এসেছে ভুলে/জগতের মাঝে,/মেঘ-রোদ্দুরের তপস্যার ধন
স্নেহধন্যা ফুল ও পাপড়ির/কী আনন্দ, পাতার ওপরে বসে/নাড়ায় শরীর রমণীয় যেন/জয় করে নিল পুরো গ্রহ
মাটি ও মানুষ,/আমি তাকে ভুল করে/ভালোবেসে/দু’হাত বাড়াই!
ষাট দশকের কবি এই শতাব্দী পার হওয়া ৩য় দশকে এসে কবিতার অস্তিত্ব কতটুকু বয়ে নিয়ে গেছেন সে কথা জানি না, কিন্তু যে প্রাণবন্ত জীবন যাপন করে গেলেন তা নিয়ে ভাবি। ভাবি, কবিতা লিখতে এসে মানুষ কিভাবে কবিতার দেখানো রাজনৈতিক দর্শনকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে গিয়ে কবিতাহারা হয়ে যায়। ভাবি, কিভাবে একটা ভাইরাল হয়ে যাওয়া কবিতা তার কবিতার পথকে বাঁকায়া ফেলে, নিয়ে যায় অচেনা কক্ষপথে!
সময় পুইরা যায়। বয়স উইরা যায়। সৌন্দর্যের ডাহুক ডাক পারে আরাবন থেকে
প্রাদেশিক বাংলাদেশে ডিজেল পুড়িয়ে পাওয়ার হাউজ থেকে আজ স্বাধীন দেশে পারমানবিক বিদ্যুৎ পর্যন্ত আসছে, জীবনের কত পরিবর্তন পাওয়া হলো!
শৈশবে বিক্রমপুরের ছড়া শুনে বড় হয়েছি:
খেঁকার কপালে চাঁদ টীপ দিয়া যা/
রূপার বাটিতে ব্যঞ্জন দেব/দুধ খাবার বাটি দেব/ধান ভানলে কুঁড়া দেব/
কালা গরুর দুধ দেব/মাছ কুটলে মুড়া দেব/
সোনার থালে ভাত দেব/রাজার মেয়ে বিয়া দেব/
খেঁকার কপালে চাঁদ টীপ দিয়া যা।
এই স্বপ্ন দেখার ভিতর দিয়াই দেখলাম কত মৃত্যু, আত্মহত্যা ও বিচ্ছেদ। রাজনিতিকরা আশা দেখালেন, কিন্তু সোনার চাঁদের দেখা পাইলাম না, শুধু কপালে ভ্রু কুঁচকাইয়া থাকলাম।
৬দফার শব্দে জেগে উঠেছিলাম, তারপর কত মার্কসবাদ, মুজিববাদ, জিয়াবাদ, এরশাদ রেজিম, খালেদা হাসিনা! এখন বিদেশ থেকে ভিসা বন্ধের ভয়!
আমি কি দেশ ছেড়ে কোথায় যেতে চাইছিলাম? কেন এমন হলো, তাই ভাবি বসে বসে। দাঁত ক্ষয় হচ্ছে, চোখে ছানি পড়ছে, হৃদপিণ্ড দুর্বল হচ্ছে, ফুসফুস ফসফস করছে, কিডনি কিটকিট করছে! কতকিছু লিখব বলে বসে আছি, কী হবে সে সব!
বইয়ের ভিতর ঢুকে বসে থাকি। এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক সময় থেকে অন্য সময়ে ভ্রমণ করি। যে উপন্যাস লিখতে চাই তাতে কখনো এক পেজ কখনো দুইটা প্যারা যোগ করি। ভাবি – একদিন নতুন তথ্যের জন্য একজনকে ফোন করব – একদিন ৩৫ বছরের আগের ডায়েরি খুলে দেখব – সেদিন কি ভেবে ছিলাম। ১৯৮৪ সালের একটা অপ্রকাশিত কবিতা বের করে মনে করব কবিতাটা কেন ছাপাই নাই! একদিন তোমার কথা মনে পড়বে – সেদিন আর কিছুই করব না – চার দশকের প্রাচীন বিষণ্ণতা ভর করবে!
সুন্দরবন নিয়া ৫টা বই জোগাড় করলাম, মাউন্টব্যাটনের মেয়ের লেখা ২টা বই, মান্টোর ৫টা বই, নজরুল রচনাবলী ১২ খণ্ড, রবীন্দ্র রচনাবলী ২৭ খণ্ড, সন্দীপনের ৪টা বই, ভৈকম ২টা, কমল কুমার ৫টা, ইরফান হাবিব ৫টা, মান্নান সৈয়দ ৫টা, আবু ইসাহাক ২টা – কতো না রচনাবলী – এইরকম ৯০০ পিডিএফ বই হান্ট করলাম গত কয়েক বছর। কখন কোনটার রেফারেন্স কাজে লাগে!
দিন যায় তাকিয়ে থাকি – জিরো কার্বনের পানে। মহাশূন্যে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আমার হয়ে দেখে। পয়গম্বরদের শিষ্যরা হৈ চৈ করে, সনাতন ঈশ্বরের চ্যালারা ইতিহাস দেখায়।
‘ঘুঙ্গিলো ঘুঙ্গি, দাওখান দে।
দাওখান কেন? পাতখান কাটব।
পাতখান কেন? বৌ ভাত খাইব।
বৌ কই? জলেরে গেছে।
জল কই? ডাউগে খাইছে।
ডাউগ কই? আরাবনে গেছে।
আরাবন কই? পুইরা গেছে।’
সময় পুইরা যায়। বয়স উইরা যায়। সৌন্দর্যের ডাহুক ডাক পারে আরাবন থেকে!